English
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

প্রকাশঃ ২০২০-০৬-১৫ ০৬:১৯:১১
আপডেটঃ ২০২৪-১১-২০ ২২:০৩:৫৩


শেষ বলতে কিছু নেই - কিছুই নেই

শেষ বলতে কিছু নেই - কিছুই নেই

আমি অণু। কাওরান বাজারে বাবার সাথে তার ফ্ল্যাটে থাকি। না না! আমি মায়ের সাথে লালমাটিয়াতে থাকি। দাঁড়ান দাঁড়ান! আমি আসলে কোথায় থাকি? যতটুকু মনে পড়ে আমরা সবাই একসাথেই থাকতাম এক সময়। আমি আমার ছোট ভাইটা, বাবা-মা। কেন যে এখন আর একসাথে থাকি না আর তাদের জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছেও করে না। কেউ একবার একদিকে ছুঁড়ে দিলো আবার আমি হোঁচট খেয়ে আরেক দিকে পিছলে পড়ে আলুর দম হলাম। কার কী আসে যায়! ফ্রিসবি হয়ে একবার লালমাটিয়া আবার কাওরান বাজার। এই করতে করতে শৈশব-কৈশোর পার করে দিলাম। জানেন আমি না আর ক্লান্ত হই না। কেন? সেইদিন দেখলাম ২০০০ সালে ঢাকায় পরিবার ভেঙ্গে তছনছ হয়েছে ২,২০০টি। আর ২০১৫ সালে বলুন তো কত? পারবেন না হয়তো কারণ আমরা এখন অনেক এগিয়ে যাচ্ছি পৃথিবীর সাথে পাল্লা দিয়ে! ২৪,০০০টি পরিবার মাত্র। ২০১৯ সাল তাহলে কি পেছনে পড়ে থাকবে? আমি কি তাহলে এগিয়ে যাবার দলেই থাকলাম না?
 
যাক-থাক। কী আসে যায় আমার? বন্ধুরা তাদের বাবা থেকে মায়ের কাছে যেতে যদি সময় নেয় দুই মিনিট। আমার লাগে দুই ঘণ্টা মাত্র! ঢাকার চাকা যে আজকাল ঘুরছে না তাতো আমরা সবাই জানি, তাই না? ক্লান্ত শ্রান্ত হতাম একটা সময়। এইচএসসি প্রথম দেবার কথা মনে পড়ছে আজ। বাবা-মায়ের দূরত্ব আর কথার ঝনঝনানি; এই হৃদয় ক্ষতবিক্ষত কতোবার হয়েছে তা গুণে শেষ করার ইচ্ছেটা মরে গেছে বহু আগেই! এক ছিল প্রিয়তমা। সেও চলে গেল কিছু না বলে। পরীক্ষা দিয়ে কী হবে! যেদিন আমার ইংরেজি লেখার কথা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, সেইদিন আমি নেশায় বুঁদ হয়ে ছিলাম আমার অন্ধকার ধোঁয়াটে ঘরে। কেউ খোঁজ নেয় নি। বন্ধুরা তো খুঁজেই পেল না আমাকে। পরিবার খোঁজ যখন পেল তখন পরীক্ষা দেবার ফায়দা নেই আর কোনো। আমি জীবনে হেরে গেলাম প্রথমবারের মতন কিন্তু তা শেষবার নয়। আসছে বছর আমার হারার লম্বা সিলসিলা যে শুরু হবে তা আর কেউ না জানুক আমি অন্তত বুঝতে পারছিলাম  বৈকি! তবুও বাস্তবতা আর কল্পনার যে বিস্তর ফারাক! মানুষ যখন হারতে থাকে তখন সব রঙ্গিন আলো ধূসর হতে কতক্ষণ লাগে বলুন তো?
 
একটা বছর। আমি আরো একা হয়ে গেলাম। অন্ধকারে আরো ঘনীভূত হলো আমার চারপাশ। কোথায় শুরু করবো আর কোথায় করবো না বুঝতেই পারছিলাম না। জীবন খুব রহস্যময় মনে হতে থাকে আমার কাছে। কাছের মানুষও কাছে থাকতে চায় না। যখন তখন কথা বলা বন্ধ করে দেয়। আকাশটা আরো মেঘলা হয়ে আসে রোদেলা দিনেও। বাতাস আরো ভারী হয়ে ঘুরতে থাকে দিশাহীন আমার চারপাশে। ঘরের ঘুণ পোকাও আমাকে ভালোবাসে না যেন। পথহারা পথিকের মতন আমি শুধু ভুলে যেতে থাকি আমাকে আর আমার পথকে। কে আমি? প্রশ্নটা আমাকে আরো অন্ধকারের দিকে টানতে থাকে যেন। মনে হতে থাকে আর কত! আর না! শেষ হোক আমার পথের দহন। দিন আর রাত আমার জন্যে সমান হয়ে যায়। নেশার মাতাল ঘোরে রক্তের কণাগুলো দেহের সাথে তর্ক করতে থাকে। আমি ডুবে যাই সীমাহীন অলসতায়। 
 
এক বিকেল। অন্ধকার বর্ণহীন মেঝেতে শুয়ে আছি। ঘরে বাতি থাকতেও নেই। বাবা এসে বললেন, বাবারে এইভাবে আর কত মরে মরে থাকবি? চল উঠ বাবা। আর না। সিগেরেটের ভারী গন্ধে শরীর-মন আর সায় দিচ্ছে না। তবু বাবা জোর করেই গোসল করিয়ে দিলেন। ওজন কমে গেছে অনেক। পাতলা দুর্বল দেহটি আমার নিয়ন্ত্রণে নেই বুঝতে পারছিলাম বেশ! খাবার খাইয়ে দিলেন বাবা। বারান্দার ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে শুয়ে আছি আমি। মৃদুমন্দ বাতাসে খুব অবাস্তব বিকেল। You need to get up Anu! This is one life and this is one last try! Wake up, will you? কথাগুলো ছাতার মতন বেড়ে যাওয়া মোটিভেশনাল স্পিকারদের কাছে কতই না শুনলাম এই ক’দিন। কিন্তু বাবার কন্ঠে কী যেন ছিল। ধক করে উঠলো যেন ভেতরটা! 

আবারো একটা বার জীবন শুরু করা যাবে? আসলেই কি আমি শেষ হয়ে যাই নি?
২০১৯ জুন। আমি অণু। বাংলাদেশের এক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের core English faculty member. কিছুদিন আগে হার্ভার্ডে আমার একটা পেপার তাদের পাবলিকেশনে সিলেক্ট হলো। ছাত্ররা আমার কাছে আসে জীবনের নতুন খোঁজে, জ্ঞানের দরবারে একসাথে হাঁটতে। আমি সেই অণু, যার জীবনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই ছিল না, আজকে আলোর মিছিলের অগ্রপথিক আমি। পরের বছর এইচএসসি দিয়ে প্রাইভেট এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম ইঞ্জিনিয়ার হব বলে। পরের দু’বছর আমি 1.2 CGPA নিয়ে পড়া ছাড়ার শেষ যখন ভাবছি তখনই এক বন্ধু বলল, Anu hear out your heart. Is Engineering you want or there is something else inspires you more? ভাবতে ভাবতেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শেষ সতর্কতা। CGPA বাড়াতে না পারলে বহিষ্কার। আবারো বুকের ভেতরের সে আতঙ্ক ভর করলো আমার অস্তিত্ব জুড়ে। আবার পা হড়কে খাদে পড়ে যাবার আশঙ্কা। অনেক ভেবে চিন্তে দেখলাম সাহিত্য পড়তে খুব ভালো লাগে আমার। William Shakespeare, Jonathan Swift, John Milton, William Wordsworth তাদের অমর কাজগুলো ছুঁয়ে যেত আমায়। অবশেষে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। 
 
ভাবতে ভালো লাগে, পড়া ছেড়ে দিয়ে; জীবনকে শেষ করার দিনকে শেষ করে, আমি আমার থেকে ছোট ছোট ভাইবোনদের সাথে পড়ে প্রথম সারির ফলাফল নিয়ে বের হতে পেরেছি। ইউকে থেকে মাস্টার্সে দুর্দান্ত রেজাল্ট নিয়ে আমি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যারা আমাকে বিদায় দিতে চেয়েছিল। অন্য বিভাগের হলেও আমার প্রাক্তন শিক্ষকদের সাথে যখন দেখা হয়, তাদের মুখের বিস্ময় দেখে বুকের ভেতরের কোনো এক জায়গায় জয়গান যেন বেজে উঠে। কী অবিশ্বাস্য এক জীবন ¯্রষ্টা আমাকে দিলেন! মাদক ছেড়ে, সিগারেটের ঘূর্ণিজাল ভেদ করে আজকে নীল আকাশের নিচে আমি অণু। 
 
আজকে মনে পড়ছে কোরআনের সেই অমোঘ বাণী, ‘নিজের ভেতর থেকে না বদলালে আল্লাহ কোনো মানুষের অবস্থান বদলান না’(১৩: ১১) আসলে জানেন, শেষ বলতে কিছু নেই - কিছুই নেই। You can rise any day from anywhere if you just believe, if you just try one more time. 'When the going gets tough, the tough gets going' আমি অণু এইভাবেই বিশ্বাস করি। পৃথিবী ভেতরটাকে ছিঁড়ে দিতে পারে, আমি যদি আরেকবার দাঁড়াই, আমার ভেতরের আমি যদি আরেকবার বলি 'Enough is Enough. I can I will' আমি জানি পৃথিবী আমার। কেউ অধিকার দিয়ে দেয় না, অধিকার আদায় করে নিতে হয়। মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেও আরেক বার কি কন্ঠ মেলাবেন আমার সাথে, ‘শেষ বলতে কিছু নেই - কিছুই নেই’। 
মৃত্যুও কি আরেক শুরু নয়?   
 
(জীবন থেকে নেয়া সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

লেখক পরিচিতি: চিফ ট্রেইনিং অ্যান্ড প্রসেস স্পেশালিস্ট, গ্রাফাইট ফেসিলিটেশন


ক্যাটেগরিঃ লেখালেখি,


Tanvir



বৈশাখে ইলিশ নয়

বৈশাখে ইলিশ নয়

উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত

সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি

সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি

বাতিলযোগ্য সাইবার নিরাপত্তা আই.. বিস্তারিত

সাকিব: বিতর্ক যার সঙ্গী

সাকিব: বিতর্ক যার সঙ্গী

বাংলাদেশ তখনো বিশ্ব ক্রিকেট অঙ.. বিস্তারিত