মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
অন্য একটি দেশের ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করে তাকে অনুগত বা নতজানু রাখার প্রক্রিয়া কোনো নতুন বিষয় নয়। যুগে যুগে কালে কালে এই প্রচেষ্টা চলে এসেছে। কখনো তা শক্তি প্রয়োগ করে, কখনো আর্থিক ভাবে, কখনো বা সামাজিক- সাংস্কৃতিক ভাবে। একেক সময় একেক অস্ত্র বা উপকরণ এই কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের অন্যতম অস্ত্রের নাম ভ্যাকসিন বা টিকা। পৃথিবী জুড়ে করোনা ভাইরাসজনিত রোগের বিস্তার এবং এর মাধ্যমে তীব্র আতংক সৃষ্টি করে মানুষের মনে অসহায়ত্বের জন্ম দেয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এখন ভ্যাকসিন হয়ে উঠেছে কাউকে নিয়ন্ত্রণ, বশে রাখা, সম্পর্ক উন্নয়ন এবং শিক্ষা দেয়ার অন্যতম উপকরণে। অনেক ক্ষেত্রেই দেশগুলোর কাছে ভ্যাকসিন সংগ্রহে রাখা আত্মমর্যাদার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। আমেরিকা থেকে পশ্চিমবঙ্গ- নির্বাচনী জনসভার জনপ্রিয় বিষয়ও এই ভ্যাকসিন। ২০১৯ সালের শেষ প্রান্তে বিস্তার শুরু হওয়া করোনা ভাইরাস ডিজিজ- ২০১৯ সংক্ষেপে কোভিড-১৯ পুরো পৃথিবীকেই নতুন বাস্তবতার সামনে নিয়ে এসেছে। যা করোনার চেয়েও অনেক গুণ বেশি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।
চায়নার উহানে করোনা প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পরও অনেকেই এটাকে গুরুত্ব দেন নি। এ বিষয়ে আগাম কোনো আশংকার কথাও শোনা যায় নি। তবে মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠাতা এবং পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ ধনী বিল গেটস ২০১৫ সালে কানাডার ভ্যাংকুভার শহরে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান টেড টকে বলেছিলেন, ‘আগামী কয়েক দশকে পৃথিবীতে এক কোটি বা তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা যাবে। এই মৃত্যু কোনো অস্ত্রে হবে না। এর কারণ হবে জীবাণু। যা যুদ্ধের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হবে।’
সাম্প্রতিক সময়ে করোনা বিস্তারের পর বিল গেটসের কাছে অনুভূতি জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে আমি যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, করোনার ভয়াবহতা তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। আমরা আগে থেকেই জানি যে বিজ্ঞান ও ভাইরাস যুদ্ধে কে কোথায়, কোন অবস্থানে দাঁড়িয়ে। তাই সারা বিশ্বের উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করবে আমাদের সংস্থা।’
বিল গেটসের সংস্থা গেটস ফাউন্ডেশন করোনার শুরু থেকেই সোচ্চার থেকেছে এবং করোনা প্রতিরোধে ভ্যাকসিনের ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। বহু বছর ধরে ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করেন বলে তাদের এক ধরনের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হয়। করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঘটার শুরুতেই ৫ এপ্রিল ২০২০ সালে বিবিসি জানায়, বিল গেটস ব্যাপক সংখ্যক ভ্যাকসিন তৈরি করার জন্য অন্তত সাতটি বিশাল আকারের কারখানায় বিনিয়োগের ঘোষণা দেন। আমেরিকার টিভি টক শো ‘দি ডেইলি শো’-তে তিনি এ কথা বলেন। পৃথিবীর কোথাও তখনো বিজ্ঞানীরা করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে পারেন নি। তারা চেষ্টা করছিলেন। তখন গবেষকরা মন্তব্য করছিলেন, এক থেকে দেড় বছরের আগে ভ্যাকসিন তৈরি করা সম্ভব নয়!
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিল গেটস তখন বলেছিলেন, ‘সংক্রামক রোগের ব্যাপারে আমাদের ফাউন্ডেশনের যেহেতু খুবই গভীর অভিজ্ঞতা আছে আমরা তাই এই মহামারি নিয়ে অনেক ভেবেছি। আমরা একটা ভ্যাকসিন তৈরির প্রচেষ্টায় অর্থ সাহায্য দিয়েছি। আমাদের দ্রুত আর্থিক সাহায্য এই প্রচেষ্টাকে অনেক ত্বরান্বিত করতে পারে।’
রয়টার্স ২৫ মার্চ ২০২১ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিল গেটসের আরেকটি ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে জানায়। বিল গেটস পোল্যান্ডের ওয়ারশে সংবাদমাধ্যমকে জানান, ভ্যাকসিনের প্রয়োগের মাধ্যমে ২০২২ সালের শেষ নাগাদ কোভিড-১৯ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
পশ্চিমা বিশ্বে বর্তমান সময়ের প্রভাবশালী স্কলার জেরুসালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক ও বহুল প্রচারিত ‘সেপিয়েন্স’ বইয়ের লেখক ইউভাল নোয়াহ হারারি ২০ মার্চ ২০২০ সালে ফিনানশিয়াল টাইমস পত্রিকায় ‘দি ওয়ার্ল্ড আফটার করোনাভাইরাস’ শিরোনামে একটি আলোচিত লেখা লেখেন। তার এই লেখা এবং বিবিসি-সহ একাধিক গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এই মহামারির পর এমন এক গণনজরদারি রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব হতে পারে, যেখানে সরকার প্রতিটি নাগরিকের প্রতিটি মুহূর্তের চলাফেরা শুধু নয়, তার আবেগ-অনুভূতি, পছন্দ-অপছন্দের খবরও জেনে যাবে।’
তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটি করেন তা হলো, ‘হাজার বছরের কালপরিক্রমায় করোনা মহামারি হয়তো ইতিহাসে তেমন ভাবে জায়গা করে নেবে না। তবে এই সময়টি চিহ্নিত হয়ে থাকবে মানুষের ওপর নজরদারি বাড়ানোর সূচনা সময় হিসেবে।’
ইউভাল নোয়াহ হারারি আশংকা প্রকাশ করেন, ‘এই মহামারির সময় যেসব স্বল্প মেয়াদী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেগুলো পরে পাকাপাকি ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর সেই পথ ধরে উত্থান ঘটতে পারে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার, যেখানে চলবে গণনজরদারি। অন্যদিকে বিশ্বায়নের পরিবর্তে জাতীয়তাবাদী একলা চলো নীতি অনুসরণ করবে অনেক রাষ্ট্র।...এটা শুরু হবে মহামারি মোকাবেলার নামে মানুষের চামড়ার নীচে কোনো মাইক্রোচিপ ঢুকিয়ে দিয়ে বা ট্র্যাকিং-এর জন্য হাতে বেড়ি পরিয়ে। সরকার হয়তো বলবে, যারা নিয়ম ভাঙ্গবে তাদের শাস্তির জন্য এই ব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তবে এটি পুরো জনগোষ্ঠীর ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারিতে কাজে লাগবে।’
তার এই কথার সাথে কিছু মিল অনেকেই খুঁজে পান যখন মার্চ ২০২০-এ বিল গেটস বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আমাদের কিছু ডিজিটাল সার্টিফিকেট দরকার যার মাধ্যমে কে রোগ মুক্ত হলেন বা কে নতুন পরীক্ষা করিয়েছেন এবং ভ্যাকসিন আসার পর বুঝতে পারবো কে ভ্যাকসিন নিয়েছেন।’
করোনা ভাইরাস ও ভ্যাকসিন নিয়ে বিল গেটসের কর্মকাণ্ড অনেক আমেরিকানেরই ভালো লাগে নি। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। বিল গেটস ভ্যাকসিন দেয়ার পরবর্তী ধাপ হিসেবে তার কোম্পানির তৈরি চিপস মানবদেহে প্রতিস্থাপন করবেন কি না- এই নিয়ে এক জরিপে শতকরা ২৮ ভাগ আমেরিকানই বিষয়টিতে সম্মতি জানিয়ে তাদের আশংকা প্রকাশ করেন। কয়েকটি সংগঠন বিল গেটসের বিরুদ্ধে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’করার অভিযোগ তোলে।
বিল গেটসকে নিয়ে অসংখ্য কার্টুন ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এর মধ্যে একটি কার্টুন ব্যাপক ভাবে শেয়ার হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাধারণ ব্যবহারকারী থেকে শুরু করে কার্টুনটির একটি ভার্সন টুইটারে শেয়ার করেন আরেক শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক পর্যন্ত। এখানে প্যানডামিক শব্দটিকে ‘প্ল্যানডামিক’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। কার্টুনটিতে বিল গেটসের পরিকল্পনার পর্যায়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। এর প্রথম ধাপে আতংক বিস্তার, দ্বিতীয় ধাপে তথ্য নিয়ন্ত্রণ এবং সেন্সরশিপ, তৃতীয় পর্যায়ে শাট ডাউন বা লক ডাউন এবং সামাজিক দূরত্ব, চতুর্থ পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দোষারোপ করা, পঞ্চম পর্যায়ে সামরিক শাসন বা কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং ষষ্ঠ পর্যায়ে বাধ্যতামূলক ভ্যাকসিন গ্রহণকে দেখানো হয়েছে।
বিল গেটস ঘোষণা দেন, ভ্যাকসিন সবার কাছে পৗেঁছে দিতে তার সংগঠন ৩০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে। তবে ভ্যাকসিন জগতে অভিভাবকত্বের স্থানটি নেয়ার বিষয়ে বিল গেটসের যতোটা আগ্রহ দেখা যায়, পুরো পৃথিবীর সাধারণ মানুষের কাছে ভ্যাকসিন তৈরির জ্ঞান পৌঁছে দেয়ার বিষয়ে তাকে সে পরিমাণ সক্রিয় দেখা যায় নি। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর ভারতসহ সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে ভ্যাকসিন বা টিকার ফর্মুলা উন্মুক্ত করার একটি প্রস্তাব আলোচিত হলে বিল গেটস এতে তীব্র আপত্তি করেন।
বিশেষ করে ভারতে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ভ্যাকসিনের ফর্মুলা ভারতের সঙ্গে শেয়ার করা হবে কি না- জানতে চাইলে সংবাদমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে বিল গেটস বলেন, ভারতের সঙ্গে ভ্যাকসিনের ফর্মুলা শেয়ার করার পক্ষপাতী নন তিনি। ভারত পৃথিবীর অন্যতম বড় ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী দেশ হওয়ার পরও বিল গেটস এই মন্তব্য করেছিলেন। তিনি তখন যুক্তি দিয়েছেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থা হয়েছে। তাদের হাতে টিকার ফর্মুলা গেলে ভ্যাকসিনের নিরাপত্তাই বিঘ্নিত হবে। টিকার মান বজায় থাকবে না। ফলে বিশ্বজুড়ে বিপদ বাড়বে।’
এক হিসেবে জানা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যভুক্ত ১৯৪টি দেশে অন্তত ১৫০০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হবে। অর্থমূল্যে যা আনুমানিক দশ লাখ কোটি টাকার ব্যবসা! বিল গেটস কোনো একক ব্যক্তি নন, তিনি এমন এক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন যেখানে টাকাই হয়ে পড়ে সব কিছুর উপরে। সাম্প্রতিক সময়ে বিল গেটস করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে ফাইজারের টিকাকে প্রশংসা করেন। জানা যায়, অন্তত চারটি ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে বিল গেটস বা তার ফাউন্ডেশনের সরাসরি বিনিয়োগ আছে। ২০০২ সাল থেকেই ফাইজারে বিনিয়োগ করে গেটস ফাউন্ডেশন। বায়ো এন টেকে শুধু ২০১৯ সালেই গেটস ফাউন্ডেশন বিনিয়োগ করে ৫৫ মিলিয়ন ডলার। এই কোম্পানিতে তাদের মোট বিনিয়োগ একশ মিলিয়ন ডলার। করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করা আরেক জার্মান কোম্পানি কিউরভ্যাকে ২০১৫ সালে ৫২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেন তারা। ভির বায়োটেকনোলজি নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান বিনিয়োগকারী হচ্ছে গেটস ফাউন্ডেশন। ২০১৭ সালে তারা এখানে বিনিয়োগ করেন। ভির বায়োটেক সম্প্রতি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লেইনের সাথে যৌথ ভাবে গবেষণা করছে।
বিল গেটসের নানা উদ্যোগ কিংবা ইউভাল নোয়াহ হারারির লেখা যখন প্রকাশিত হয়ে পশ্চিমা বিশ্বে আলোচনা সৃষ্টি করছে তখনো বাংলাদেশসহ অধিকাংশ দেশেই করোনা ভাইরাস নিয়ে মানুষের মনে কোনো আশংকা কাজ করে নি। কিন্তু ধনী দেশগুলোতে ভ্যাকসিন নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও উৎপাদনের আগে থেকেই। ভ্যাকসিন কূটনীতি হয়ে ওঠে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক রক্ষার নতুন মাধ্যম। সহজ ভাষায় সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের অস্ত্র। নিজের দেশের চাহিদা পূরণ না করেও প্রভাব বিস্তারের জন্য অন্য দেশে আগাম ভ্যাকসিন উপহার কিংবা সরবরাহ করার ঘোষণা দেয়ার প্রতিযোগিতায় নামে দেশগুলো। আমেরিকার ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর জুডি টুইগ উপহাস করে বলেন, ‘নিম্ন এবং মধ্য আয়ের দেশগুলো দ্রুত ভ্যাকসিন পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এদের মানসিকতা হলো যা পাই তাই নেবো, যেখানে যা পবো নিয়ে নেবো।’
বিভিন্ন দেশ এখন পর্যন্ত ১৫টি ভ্যাকসিন জরুরি প্রয়োজনে অনুমোদন দিয়েছে। তবে এগুলোর মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত ভ্যাকসিন হলো: আমেরিকা ও জার্মানির ফাইজার বায়ো এন টেক, সুইডেনের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, আমেরিকা ও নেদারল্যান্ডসের জনসন অ্যান্ড জনসন, আমেরিকার মডার্না এবং চায়নার সিনোফার্মের বিবিআইবিপি-করভি। এসব কোম্পানি আবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের ভ্যাকসিন উৎপাদনের অনুমতি দিয়ে ব্যবসায়িক চুক্তি করেছে। যেমন ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন ‘কোভিশিল্ড’ উৎপাদনের অনুমোদন নিয়েছে। এর বাইরে রাশিরায় স্পুটনিক ভি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন এখনো না পেলেও বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশ এই ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে।
আমেরিকা প্রাথমিক ভাবে ছয়টি কোম্পানির সাথে ৩০০ কোটি ডলারের ভ্যাকসিন সংগ্রহের চুক্তি করে। রাশিয়া এক সময় স্পুটনিক নভোযান আকাশে পাঠিয়ে মহাকাশ জয় করেছিল রাশিয়া। এখন স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিন দিয়ে তারা বিশ্ব জয় করতে চায়। বাংলাদেশ, ভারত, আরব আমিরাত, ব্রাজিল, আর্জেনটিনা, ইন্দোনেশিয়াসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে স্পুটনিক ভি হয়ে উঠছে খুবই কাঙ্খিত বস্তু। চায়নার বিরুদ্ধে অভিযোগ তারাই উহানে করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে। যা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। আমেরিকার বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে চায়না ভ্যাকসিন দিয়ে সারা পৃথিবীতেই নিজের অবস্থান দৃঢ় করার উদ্যোগ নেয়। তারা বাংলাদেশেও ভ্যাকসিন উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে। আগামীতে বাংলাদেশ দেড় কোটি ভ্যাকসিন চায়না থেকে কিনবে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা হলো চায়নার ভ্যাকসিন পরিকল্পনার বড় এলাকা। ভারত নিজ দেশে ব্যাপক সংখ্যক করোনা রোগী থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ, নেপাল, মিয়ানমার, শ্রীলংকা এবং আফগানিস্তানকে ভ্যাকসিন দেয়ার আগাম প্রতিশ্রুতি দেয়।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী কোম্পানি হিসেবে পরিচিতি ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইনডিয়া ভ্যাকসিন উৎপাদনে যে লক্ষ্যমাত্রা সবার সামনে তুলে ধরে বাস্তবে কাজ করতে গিয়ে তারা সেখানে ব্যর্থ হয়। জানা যায়, ২৪ মার্চ ২০২১ সাল পর্যন্ত ভারত যে এগারো কোটি ২০ লাখ ডোজ উৎপাদন করে তার মধ্যে ছয় কোটি ডোজই দেশের বাইরে রফতানি করে। টাইমস অফ ইনডিয়া জানায়, ন্যূনতম লক্ষ্যমাত্রা থেকে সেরাম প্রতিদিন অন্তত দশ লাখ ডোজ পিছিয়ে আছে। ভারতে শুরুতে তরুণদের ভ্যাকসিন না দেয়ার কথা বলা হলেও পরে সরকার নীতি পরিবর্তন করে। একই সঙ্গে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়া এবং ব্ল্যাক ফাঙ্গাস আতংকে ভারত ভ্যাকসিন দেশের বাইরে পাঠানো পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। দেশের ভেতর অব্যাহত চাপ এবং নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে সেরামের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার- সিইও আদর পুনাওয়ালা কাউকে কিছু না জানিয়ে লন্ডন চলে যান পরিবার নিয়ে। তিনি সেখান থেকে ভ্যাকসিন খাতে ২৪০ মিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগের ঘোষণা দেন। তিনি ‘শিগগিরই’ দেশে ফিরবেন বলেও জানান। তবে তিনি ফিরে আসেন নি। বরং আদর পুনাওয়ালার বাবা সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা সাইরাস পুনাওয়ালা ‘গ্রীষ্মের ছুটি’ কাটাতে লন্ডনে ছেলের সাথে যোগ দিয়েছেন। ভারতীয় নাগরিকরা হন্যে হয়ে গুগল সার্চে আদর পুনাওয়ালা ও তার স্ত্রীর খোঁজ করে চলেছেন। এর মধ্যে এক বৃটিশ পত্রিকা জানিয়েছে লন্ডনের অভিজাত এলাকা মেফেয়ারে একজন পোলিশ ধনকুবেরের বিশাল ম্যানসন প্রতি মাসে বাংলাদেশি টাকায় দুই কোটি পঁয়ত্রিশ লাখ টাকায় ভাড়া নিয়ে সেখানে পুনাওয়ালা পরিবার বিলাসী জীবন কাটাচ্ছেন।
আদর পুনাওয়ালার টুইটার অ্যাকাউন্ট
এই সেরাম ইনস্টিটিউট থেকেই বাংলাদেশে ভ্যাকসিন আমদানির চুক্তি করা হয়। বাংলাদেশের ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একমাত্র বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস সরকারি এবং বেসরকারি দুই পর্যায়েই সেরাম থেকে ভ্যাকসিন আনার অনুমতি পায়। সেরাম ছয় মাসের মধ্যে তিন কোটি ভ্যাকসিন পাঠানোর জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। বাংলাদেশ সরকার, সেরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকো ফার্মার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়। ভারতে ভ্যকাসিন রফতানি বন্ধ করে দিলে সত্তর লাখ ডোজ টিকা আসার পর তা আটকে যায়। বাকি প্রায় দুই কোটি ত্রিশ লাখ ডোজ টিকা কবে পাওয়া যাবে তা অনিশ্চিত। ফলে বাংলাদেশের টাকা যেমন আটকে গিয়েছে, তেমনি চুক্তি মোতাবেক ভ্যাকসিন পাওয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের প্রভাবশালী দৈনিক প্রথম আলো একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে এই বিষয়ে। তারা জানায়, প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনে বেক্সিমকো ৭৭ টাকা করে লাভ করেছে।
প্রথম আলো পত্রিকার উদ্যোক্তাদের মালিকানাধীন ঔষধ কোম্পানির নাম এসকেএফ। বাংলাদেশে প্রথম করোনার ঔষধ আবিষ্কার নিয়ে এসকেএফ ও বেক্সিমকো প্রচারণার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছিল। বেক্সিমকোর মালিকাধীন ইনডিপেন্ডেন্ট টিভি চ্যানেল ও একই নামে একটি ইংরেজি দৈনিক আছে।
ভ্যাকসিন নিয়ে এতো উত্তেজনা, হাহাকার এবং অর্থ ব্যয়ের পরও শারীরিক সুরক্ষায় তা কতোটুকু নিশ্চয়তা দেবে তা কেউ বলতে পারছেন না। যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ তা হলো:
১. ভ্যাকসিনের রোগ প্রতিরোধ মেয়াদকাল ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ এক বছর।
২. দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেয়ার পরও মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।
৩. শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা অভ্যন্তরীণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় ভ্যাকসিন কোনো সমস্যা করে কি না তা এখনো অজানা।
অতি সম্প্রতি ফ্রান্সের ভাইরোলজিস্ট ২০০৮ সালে নোবলজয়ী লুক মন্টাগনিয়ার ১৯ মে ২০২১ সালে মন্তব্য করেন, ‘গণহারে ভ্যাকসিন দেয়ার বিষয়টি একটি গুরুতর ভুল সিদ্ধান্ত। এতে রোগ নিরাময়ের চেয়ে কোভিড ভাইরাস আরো শক্তিশালী হচ্ছে। এই ভ্যাকসিন প্রদান অনেকেরই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’
বৃটেনের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ২০১৭ সালে ‘দি পলিটিকস অফ ভ্যাকসিনেশন: এ গ্লোবাল হিস্ট্রি’নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। ক্রিস্টিন হোমবার্গ, স্টুয়ার্ট বুম এবং পল গ্রিনফ সম্পাদিত এই বইয়ে তুলে ধরা হয়, ভ্যাকসিনের মাধ্যমে শারীরিক সুরক্ষার চেয়েও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সুবিধা কতোটা নেয়া যায় সেটাই অনেক সময় নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য হয়ে পড়ে। বইটিতে বিভিন্ন উদাহরণের পাশাপাশি ১৯৫৮ সালের সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মহামারির বিষয়টি কেস স্টাডি হিসেবে তুলে ধরা হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভ্যাকসিন না নেয়ার আন্দোলন শুরু হয়েছে। এই প্রতিবাদকারীরা মনে করেন, ভ্যাকসিন বিক্রি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আতঙ্ক ছড়ানো চলবেই। কিছু দেশে সরকারি ভাবেই ভ্যাকসিন গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডরোথি গোয়াজিমা সম্প্রতি এক প্রেস কনফারেন্সে ভ্যাকসিনের পরিবর্তে আদা, পেঁয়াজ, লেবু ইত্যাদি প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব বলে জানান। ইরিত্রিয়া, মাদাগাস্কার, বুরুন্ডি-সহ আরো কিছু দেশ ভ্যাকসিনের বিষয়ে মোটেও আগ্রহী নয়।
বৃটেনে প্রতিবাদকারীরা ফেস্টুনে লেখেন, ৯৯.৭% মানুষ যদি কোভিড থেকে নিরাময় পান তাহলে ভ্যাকসিন নেয়ার প্রয়োজন কী?
পাদটীকা
বর্তমান বিশ্বের জনপ্রিয় থ্রিলার লেখক ড্যান ব্রাউন। তিনি তার লেখায় ইতিহাস, শিল্প এবং বিজ্ঞানের চমৎকার মিশ্রণ ঘটান। ২০১৩ সালের মে মাসে তিনি তার ‘ইনফার্নো’ উপন্যাসটি প্রকাশ করেন। এটি নিয়ে পরে হলিউডে মুভি হয়। বইটিতে বারট্রেন্ড জবরিস্ট নামে পৃথিবীর অন্যতম ধনী বিলিওনেয়ার চরিত্র আছে। মানুষের নানা সমস্যার সমাধানের জন্য চমৎকার করে তিনি বক্তৃতা করেন। জবরিস্ট মনে করেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে জনসংখ্যা। এই সমস্যা সমাধানে তিনি গোপনে বহু খরচ করে এমন এক ছোঁয়াচে ভাইরাস সৃষ্টি করেন যা মানুষের উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট করে দেবে। সেই ভাইরাস তিনি লুকিয়ে রাখেন তুরস্কের একটি স্থানে। উপন্যাসের নায়ক রবার্ট ল্যাংডন হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ান তা অপসারণ করার জন্য। বারট্রেন্ড জবরিস্ট তার ভিডিও বার্তায় মানব কল্যাণে তার এই ভাইরাস তৈরির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি মনে করেন, এখন তাকে দোষারোপ করা হলেও এক সময় পৃথিবীর মানুষ তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন।
প্রিয় পাঠক, এটি একটি উপন্যাস। বাস্তবের কোনো চরিত্রের সাথে এর মিল খুঁজতে যাওয়া ঠিক নয়!
সম্পাদক, বিপরীত স্রোত। সাংবাদিক ও গবেষক। অ্যাসোসিয়েট ফেলো, রয়াল হিস্টোরিকাল সোসাইটি।
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত
বাতিলযোগ্য সাইবার নিরাপত্তা আই.. বিস্তারিত
বাংলাদেশ তখনো বিশ্ব ক্রিকেট অঙ.. বিস্তারিত
ব্রেদিং আউট বার্ডেন নামে কর্ম.. বিস্তারিত