English
ঢাকা, রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

প্রকাশঃ ২০২১-১০-১১ ১৫:৪৩:০২
আপডেটঃ ২০২৪-০৯-০৬ ০৪:৫২:০৮


সৃষ্টি রহস্যের খোঁজে সত্যেন্দ্রনাথ বসু

সৃষ্টি রহস্যের খোঁজে সত্যেন্দ্রনাথ বসু


 বজলুল করিম আকন্দ 

 

ইদানীং বিজ্ঞানের জগতে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান এবং হিগ্স বোসন বা ঈশ্বর কণা বহুল আলোচিত বিষয় শুরুতে কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন এই উপমহাদেশের বিশিষ্ট বাঙালি পদার্থবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান সত্যেন্দ্রনাথ বসু আইনস্টাইনের সঙ্গে যৌথভাবে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান প্রদান করেন, যা পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বলে বিবেচিত হয়

সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৮৯৪ সালের জানুয়ারি কলকাতা শহরে জন্মগ্রহণ করেন তাঁর বাবা সুরেন্দ্রনাথ বসু পূর্বভারতীয় রেলওয়েতে একজন হিসাবরক্ষক ছিলেন আর মা আমোদিনী দেবী ছিলেন আলীপুরের বিখ্যাত উকিল মতিলাল চৌধুরীর কন্যা সত্যেন্দ্রনাথ বসুর শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলে এরপর তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯০৯ সালে সেখান থেকে পঞ্চম স্থান পেয়ে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এরপর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯১১ সালে এফ.. পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন ১৯১৩ সালে একই কলেজ থেকে গণিতসহ স্নাতক ১৯১৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন এবং উভয় পরীক্ষায় তিনি রেকর্ড মার্কস পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন

শিক্ষাজীবনে তিনি আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু এবং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো মহান ব্যক্তিদের সান্নিধ্য লাভ করেন স্নাতকও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির মাঝামাঝি সময়ে ডাক্তার যোগেন্দ্রনাথ ঘোষের কন্যা উষাবতী দেবীর সাথে তাঁর বিয়ে হয় ছাত্রজীবনে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার পরও তাঁর চাকরি জুটল না সেসময় তিনি বহু সরকারি অফিস এবং কলেজে চেষ্টা করেও সুযোগ পান নি কৃতী ছাত্রের উপযুক্ত চাকরি নেই বলে তাঁকে জানানো হয় তাই তিনি টিউশনি শুরু করলেন তাঁর সর্বশেষ ছাত্র ছিলেন প্রমথেশ বড়য়া এমন সময় স্যার আশুতোষ মুখার্জি তাঁকে ডেকে পাঠালেন তাঁর পরামর্শে তিনি প্রভাষক হিসেবে বিজ্ঞান কলেজে যোগদান করেন এখানে এসে তিনি . মেঘনাদ সাহার সাথে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার সুযোগ পান মেঘনাদ সাহার সাথে তিনি যৌথভাবে মূল জার্মান ভাষা থেকে আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটির পেপারগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং রিসার্চ স্কলার হিসেবেও সেখানে কাজ চালিয়ে যান

ইতিমধ্যে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে রিডার হিসেবে যোগদান করেন এখানে এসে তিনি তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির ওপর কাজ শুরু করেন শ্রেণিকক্ষে তিনি কোয়ান্টাম বলবিদ্যা পড়াতেন ক্লাসে একদিন আলোকতড়িৎ ক্রিয়া অতিবেগুনি বিপর্যয় পড়ানোর সময় তিনি বর্তমান তত্ত্বের দুর্বলতা বোঝাতে এই তত্ত্বের সঙ্গে পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের ব্যত্যয় তুলে ধরেন সেসময় তিনি ওই তত্ত্ব প্রয়োগ করতে গিয়ে একটু ভুল করেন পরে দেখা যায় ওই ভুলের ফলে পরীক্ষার সঙ্গে তত্ত্বের অনুমান মিলে যায় সত্যেন্দ্রনাথ বসু পরে তাঁর ওই দিনের লেকচারটি একটি রিসার্চ পেপার হিসেবে, ‘প্ল্যাঙ্কের সূত্র আলোক কোয়ান্টা তত্ত্বশিরোনামে লিখে ফেলেন এবং সেটি সেসময়ের বিখ্যাত জার্নালফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিন’- পাঠান অমনোনীত হয়ে ফিরে আসে তা হতাশ সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবার আইনস্টাইনের শরণাপন্ন হন পেপারটি আইনস্টাইনের নিকট পাঠান যাতে তিনি দয়া করে কোথায়ও তা ছাপিয়ে দেন এই আশায় পেপারটির গুরুত্ব বিবেচনা করে আইনস্টাইন সেটি ইংরেজি থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন এবংজাইটশ্রিফ্ট ফুর ফিজিক’- ছাপানোর ব্যবস্থা করেন আর বসুর আলোচিত বিষয়ের সঙ্গে তাঁর নিজের লেখা একটি পেপার জুড়ে দেন পরিশেষে বসু কর্তৃক প্ল্যাঙ্কের সূত্র নির্ধারণ পদ্ধতি-একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলেও মন্তব্য করেন ওই দুই পেপারের সূত্রে জন্ম নেয় বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান অর্থাৎ বসুর সেদিনের শ্রেণিকক্ষেরব্যত্যয়বিখ্যাত তত্ত্বে পরিণত হয় আইনস্টাইন এই ধারণাটি গ্রহণ করে তা প্রয়োগ করলেন পরমাণুতে থেকে পাওয়া গেল বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন মেনে চলে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান এমন একটি সংখ্যায়ন পদ্ধতি যার মাধ্যমে পদার্থের পূর্ণসংখ্যার ঘূর্ণন বিশিষ্ট মৌলিক কণাদের বন্টন ব্যাখ্যা করা হয় অর্থাৎ বিশ্বজগতের যে কণাগুলোর ঘূর্ণন পূর্ণসংখ্যা, বসুর নামে পল ডিরাক তার নামকরণ করেন বোসন কণা বোসন কণারা মেনে চলে সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং আলবার্ট আইনস্টাইন আবিষ্কৃত নিয়ম আর একদল কণা আছে তারা মেনে চলে এনরিকো ফার্মি পল ডিরাক আবিষ্কৃত নিয়ম তারা ফার্মিয়ন ফার্মিয়ন ভরযুক্ত আর বোসন ভরহীন কণা

বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন আসলে বোসন কণাদের একটি ঘনীভূত অবস্থা অতিরিক্ত লঘু ঘনত্বের গ্যাসকে পরম শূন্য তাপমাত্রার (অর্থাৎ ০০ কেলভিন বা - ২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের খুব কাছে) খুব কাছাকাছি তাপমাত্রায় ঠান্ডা করে পদার্থের এই অবস্থা পাওয়া যায় ১৯৯৫ সালে এক পরীক্ষায় এর অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবনকে পদার্থের পঞ্চম অবস্থাও বলা হয় সাধারণত পদার্থের চারটি অবস্থা যেমন গ্যাসীয়, তরল, কঠিন প্লাজমা কথা আমরা জানি সুপারকন্ডাক্টারস সুপারফ্লুইড্স বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন - এর উদাহরণ সুপারকন্ডাক্টারস- বিদ্যুৎ প্রবাহ কখনও বাধাগ্রস্ত হয় না আর সুপারফ্লুইড্স- তরলের প্রবাহ বিরতিহীনভাবে চলতেই থাকে

মহাবিশ্বে রয়েছে ভর শক্তির খেলা শুরুতে আমাদের মহাবিশ্বে ছিল শুধু শক্তি তারপর তা থেকে কণা কণাদের ভর লাভ (ভর হলো বস্তুর মোট পরিমাণ) ভর না পেলে কণারা ছুটত আলোর বেগে কেবলই ছুটে বেড়াত কেউ কারও কাছে আসত না তৈরি হতো না বস্তু মহাবিশ্ব হতো বস্তু-শূন্য ষাটের দশকে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজায় ব্যস্ত হয়েছিলেন বহু বিজ্ঞানী এঁদের মধ্যে সবচেয়ে সফল বৃটিশ বিজ্ঞানী পিটার হিগ্স ১৯৬৪ সালে হিগ্স যে কণার অনুমান করেছিলেন, তা বোসন গোত্রের নাম হিগ্স বোসন গবেষক মহলে কণাটির নাম হিগ্স বোসন হলেও প্রচারমাধ্যমে এটি ঈশ্বর কণা হিসেবে পরিচিত ২০১২ সালে জেনেভায় অবস্থিত সার্ন (ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ)- পদার্থের ভর জোগানোর হিগ্স বোসন কণার অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে বিশ এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে বোসন এর যাত্রা শুরু হয়েছিল তার সমাপ্তি ঘটল ২০১২ সালে জেনেভায় এসে প্রসঙ্গে জার্মান জ্যোতির্বিদ কার্ল  শোয়ার্জশিল্ড-এর একটি উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে তিনি বলতেন, ‘গাণিতিক সমাধান প্রায়ই প্রকৃতিকে বুঝতে পারে, যেন গণিত আর পদার্থবিজ্ঞানের মধ্যে আগে থেকেই নির্ধারিত কোনো এক ধরনের হারমোনি রয়েছে

১৯২৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ইওরোপ গমন করেন, সেখানে তিনি মাদাম কুরির সাথে দেখা করেন এবং তাঁর ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সুযোগ পান কিছুদিন তিনি দ্য ব্রগলির ল্যাবেও কাজ করেন ১৯২৭ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার প্রধান অধ্যাপক এবং সায়েন্স ফ্যাকালটির ডিন নির্বাচিত হন ১৯৪৫ সালে তিনি পুনরায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন এবং সেখানে তিনিখয়রা অধ্যাপকহিসেবে শিক্ষকতা গবেষণায় নিয়োজিত থাকেনখয়রা অধ্যাপকপদ থেকে অবসর নেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে প্রফেসর ইমেরিটাস হিসেবে নিয়োগ দেন ১৯৫৮ সালে তিনি লন্ডনের রয়েল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন ১৯৫৯ সালে ভারত সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক পদে মনোনীত করেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকেদেশিকোত্তমএবং ভারত সরকারপদ্মবিভূষণউপাধিতে ভূষিত করেন ১৯৭৪ সালে তাঁর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে উচ্চতর গবেষণার জন্যবোস চেয়ারপ্রবর্তিত হয় ১৯৮৬ সালে কলকাতা শহরের সল্ট লেকেএস.এন. বোস ন্যাশানাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেসপ্রতিষ্ঠিত হয়

বিজ্ঞানের পাশাপাশি সঙ্গীত এবং সাহিত্যেও তাঁর খুব আকর্ষণ ছিল তিনি দক্ষতার সাথে এস্রাজ বাজাতেন বাংলা ভাষায় যে বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব এটা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন তাঁর নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ গঠিত হয় এখান থেকে নিয়মিত বিজ্ঞান সাময়িকীজ্ঞান বিজ্ঞানপত্রিকা প্রকাশিত হতো মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ব্যাপারে তাঁর একটি উক্তি বিখ্যাত হয়ে আছে তিনি বলতেন, ‘যাঁরা বলেন মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয় তাঁরা হয় বাংলা জানেন না অথবা বিজ্ঞান বোঝেন না

অদূর ভবিষ্যতে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান, বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন এবং হিগ্স বোসন আদি মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন ইতিমধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কাজের জন্য অনেকেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন কিন্তু তিনি পাননি ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কিছু বলার নেই, আমার যেটুকু পাবার আমি তা পেয়েছি

তবে মহাবিশ্বের অর্ধেক কণার নাম সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামেবোসনহওয়াতে বিশ্বদরবারে তাঁর কাজের কিছুটা হলেও স্বীকৃতি মিলেছে বলা যায় জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বিজ্ঞান সাধনা করে গেছেন আইস্টাইনের মতো তাঁরও অন্তিম বাসনা ছিল সবকিছুর একটা তত্ত্ব খোঁজে পাওয়া তাঁর সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি এই মহান বিজ্ঞানী ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি কলকাতা শহরে মহাপ্রয়াণ করেন

 

লেখক পরিচিতি:

বজলুল করিম আকন্দ 

 অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ বিজ্ঞান শিল্প গবেষণা পরিষদ

 

সূত্র: সার্ন- ব্রহ্মান্ডের রহস্য সন্ধান, পথিক গুহ, দেশ; সায়েণ্টিস্ট হু মেইড বেঙ্গলিজ প্রাউড- সত্যেন্দ্রনাথ বোস, মালিহা আফরিন, সায়েন্স পেজ, দ্য ডেইলি স্টার; উইকিপিডিয়া 

 


ক্যাটেগরিঃ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি,


আরো পড়ুন