মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর শক্তির বিরুদ্ধে নিজের নৈতিক মনোবল দেখিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল। ৭ জানুয়ারি ১৮৮৬ সালে বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের হিসনা নদীর পাড়ে শালিমপুর গ্রামে জন্ম নেয়া এই বিচারপতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজয়ী আমেরিকার প্রবল চাপ সত্ত্বেও নীতিতে কোনো ছাড় দেন নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নুরেমবার্গ ট্রায়ালের অনুরূপ ‘ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইবুনাল ফর দি ফার ইস্ট’ গঠিত হয় ২৭ এপ্রিল ১৯৪৬ সালে। জনসাধারণের কাছে ‘টোকিও ট্রায়াল’ নামে পরিচিত এই বিচার ব্যবস্থায় ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপানের অপরাধের বিষয়গুরো তুলে আনা হয়। জাপান দখলকারী আমেরিকান সুপ্রিম কমান্ডিং অফিসার জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থারের তত্ত্বাবধানে এই বিচারের আয়োজন করা হয়। ১৯৪৫ সালের পোস্টডাম সনদ অনুসারে ম্যাকআর্থার এই ক্ষমতা লাভ করেন। তিনি পরিচিত পরিমণ্ডল থেকে বিচারপতিদের প্যানেল তৈরি করার উদ্যোগ নেন। যে দেশগুলো মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির পক্ষে ছিল। আমেরিকা, কানাডা, বৃটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চায়না, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপিন্স ও ইনডিয়ার ১১ জন বিচারকদের নিয়ে এই ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়। তখন একটি ধারণা প্রচলিত ছিল, এই ট্রাইবুনাল ম্যাকআর্থারের পরামর্শ মতোই কাজ করবে।
ট্রাইবুনালে বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল (দাঁড়নো- সবার বামে)
অস্ট্রেলিয়ান বিচারপতি স্যার উইলিয়াম এফ ওয়েবের নেতৃত্বে গঠিত এই ট্রাইবুনালে অবিভক্ত ভারতের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পাল। যাকে ‘বিচারকদের পুরো বেঞ্চের মধ্যে আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে একমাত্র গভীর জ্ঞানের অধিকারী’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
৪
মে ১৯৪৬ সালে ট্রাইবুনাল কাজ শুরু করে। জাপানের যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী ও সামরিক ব্যক্তিত্ব হিডেকি তোজো-সহ মোট ২৮ জনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়। এদের মধ্যে দুইজন মারা যান এবং একজন পাগল হয়ে গেলে ২৫ জনকে নিয়ে বিচার কাজ চলে। জাপানের সম্রা্রাট হিরোহিতোকে বিচারের বাইরে রাখলেও ডগলাস ম্যাকআর্থার তাকে চরমভাবে অপমান করেন।
আমেরিকান সামরিক শাসক ডগলাস ম্যাকআর্থারের পরিকল্পনা ছিল অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ডসহ নানা মেয়াদের শাস্তির পাশাপাশি জাপানের ওপর যুদ্ধাপরাধের বড় অভিযোগ এনে বিপুল পরিমাণ অর্থদণ্ড দেয়া যেন যুগের পর যুগ ধরেও তারা সেটা শোধ করতে না পারে।
পুরো ট্রাইবুনাল এক দিকে চললেও স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ান বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল। তিনি শুরুতেই ট্রাইবুনালের কর্মকাণ্ডের বিষয় গোপন রাখার শপথ নিতে অস্বীকৃতি জানান। ডগলাস ম্যাকআর্থার তাকে বিশেষ বিমানে করে আনা এবং বিলাসী স্থানে রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। রাধাবিনোদ পাল যারা জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তাদের পছন্দ অনুসারে ট্রাইবুনাল গঠনের নৈতিক অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
১৯৪৮ সালে বিচার কাজ শেষ হয়। পুরো ট্রাইবুনাল দুই ভাগে বিভক্ত হয়। একদিকে দশজন অন্যদিকে বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল! সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে হিডেকি তোজো-সহ সাত জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৬ জনের যাবজ্জীবন, একজনের ২০ বছর এবং আরেকজনের সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এছাড়াও নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় জাপানের ওপর। পাশাপাশি ট্রাইবুনাল অভিযোগ করেন, যদি পারমাণবিক হামলা না হতো তবে জাপান যুদ্ধে আত্মসমর্পন করতো না।
বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল এই রায়ের সাথে বিরোধিতা করে মত দেন, পারমাণবিক হামলা না হলেও জাপান আত্মসমর্পণ করতো। তিনি ট্রাইবুনালের রায়কে ‘প্রহসন’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি আলাদা ভাবে একটি রায় লেখেন ১,২৩৫ পৃষ্ঠার। যার মধ্যে মূল রায় ৮০০ পৃষ্ঠা এবং বাকিটা তার পর্যবেক্ষণ। কোনো আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে দেয়া এটিই ছিল সে সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রায়ের উদাহরণ। জাপানের যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি উল্লেখ করে বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল তার রায়ে লেখেন, ‘জাপানকে এককভাবে যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী করা হলে এটি হবে চরমতম ভুল। কারণ বাকি দেশগুলোও যুদ্ধাপরাধ করেছে। এর অন্যতম উদাহরণ হিরোশিমা নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা হামলা। হিরোশিমায় প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার এবং নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪ হাজার নিরীহ মানুষ মারা যান। যুদ্ধাপরাধের জন্য যদি জাপানের বিচার করতে হয় তবে বাকিদেরও করতে হবে।’
আমেরিকান প্রশাসক এই রায় প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে। তবে বিচারপতি রাধাবিনোদের অনমনীয়তার কারণে ট্রাইবুনাল ব্যর্থ হয় জাপানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনতে। একই কারণে জাপান বিশাল অংকের অর্থদণ্ড থেকেও রেহাই পায়। পাশাপাশি রাধাবিনোদের দৃঢ় অবস্থান জাপানকে সহিংসতা থেকে শান্তির পথে নিয়ে আসে। সামুরাই, কামিকাজির উত্তরাধিকার যোদ্ধা জাতি জাপানিরা শান্তিপ্রিয় যুদ্ধবিরোধী জাতিতে পরিণত হয় একজন বাঙালি বিচারপতির নৈতিক
দৃঢ়তার কারণে।
৬
আগস্ট ১৯৫২ সালে হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা হামলা স্মরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল। সে অনুষ্ঠানে তিনি দৃঢ়তার সাথে জাপানিদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘যদি জাপানিরা আবার যুদ্ধে জড়ায় তবে হিরোশিমার সেই নৃশংসতায় নিহত মানুষের প্রতি চূড়ান্ত অবমাননা করা হবে।’
জাপানি কর্তৃপক্ষ তাকে জানায়, জাপান কখনোই আর যুদ্ধে জড়াবে না এবং সবসময় শান্তির পক্ষে থাকবে। বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের কাছে দেয়া প্রতিশ্রতি জাপান রাখে এবং সে বছরই তারা ট্রাইবুনালের দেয়া রায় মেনে নেয়। যার ধারাবাহিকতায় জাপান ‘সানফ্রান্সিসকো শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষর করে। এর ফলে জাপানের ওপর দেয়া অনেক ধরনের নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের দেয়া রায়ও আলোর মুখ দেখে। ১৯৫৩ সালে রায়টি বই আকারে প্রকাশ করা হয়। জাপানিরা এই বইয়ের নাম দেয়, ‘দি বাইবেল অফ পিস’।
সম্রাট হিরোহিতো ১৯৬৬ সালে বিচারপতি রাধাবিনোদ পালকে জাপানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘কোক্কা কুনশোও’ বা ‘ফার্স্ট অর্ডার অফ সেক্রেড ট্রেজার’-এ ভূষিত করেন। বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের নামে জাদুঘর ও সড়কের নামকরণ করা হয়। তার উদ্দেশ্যে জাপানের সম্রাট হিরোহিতো বলেন, ‘যতদিন জাপান থাকবে, বাঙালি খাদ্যাভাবে অর্থকষ্টে মরবে না। জাপান হবে বাঙালির চিরকালের নিঃস্বার্থ বন্ধু।’
জাপানে রাধাবিনোদের স্মরণে নির্মিত স্মারক
বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল ১০ জানুয়ারি ১৯৬৭ সালে কলকাতায় মারা যান। জাপান সব সময়ই তার কথা মনে রেখেছে। ২০০৭ সালে জাপানিজ প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে কলকাতায় এসে বিচারপতি রাধাবিনোদের ছেলে প্রশান্ত পাল ও তার পরিবারের সাথে দেখা করেন এবং তাদের কৃতজ্ঞতা আবারো প্রকাশ করে যান। বিচারপতি রাধাবিনোদের এই নৈতিকতার বিজয় নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক ডকুমেন্টারি। ‘টোকিও ট্রায়াল’ নামের ওয়েব সিরিজে বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের চরিত্রে অভিনয় করেন প্রয়াত শক্তিমান অভিনেতা ইরফান খান।
সম্পাদক, বিপরীত স্রোত। সাংবাদিক ও গবেষক। অ্যাসোসিয়েট ফেলো, রয়াল হিস্টোরিকাল সোসাইটি।
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
মুস্তাকিম আহমেদ বিস্তারিত
সাংবাদিক শফিক রেহমানের পুরো বক.. বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত
বাতিলযোগ্য সাইবার নিরাপত্তা আই.. বিস্তারিত