English
ঢাকা, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

প্রকাশঃ ২০২২-০৪-১৮ ১৪:০৪:৩২
আপডেটঃ ২০২৪-১০-১৮ ১২:২২:২৯


ডিজিটাল সার্ভিসেস ট্যাক্স: গুরুত্ব ও বাস্তবায়ন

ডিজিটাল সার্ভিসেস ট্যাক্স: গুরুত্ব ও বাস্তবায়ন


জসীম উদ্দিন রাসেল

 

গত বছর থেকে গুগল, ফেসবুক টেক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) দেওয়া শুরু করেছে। এর ফলে বিজ্ঞাপনদাতার খরচ একই পড়ছে। অর্থাৎ একজন বিজ্ঞাপনদাতা গুগল বা ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিলে যে খরচ পড়বে তার সমপরিমাণ খরচ পড়বে বিপরীত স্রোত-এর মতো দেশি মিডিয়াগুলোতে বিজ্ঞাপন দিলে।

 

কিন্তু বিজ্ঞাপন থেকে গুগল বা ফেইসবুক এবং বিপরীত স্রোত-এর মতো দেশি মিডিয়াগুলোর আয় কিন্তু সমান হবে না। এর কারণ হলো, বিজ্ঞাপনদাতা বিপরীত স্রোত-এর মতো দেশি মিডিয়াগুলো বিল থেকে উৎসে আয়কর কেটে তারপর বিল পরিশোধ করেন যা গুগল বা ফেসবুকের ক্ষেত্রে হয় না। গুগল বা ফেইসবুক বিজ্ঞাপনের সম্পূর্ণ টাকা পেয়ে যান।

 

তাই বিজ্ঞাপনদাতার খরচ সমান থাকলেও বিজ্ঞাপন থেকে আয়ের পরিমাণ সমান থাকছে না। এজন্য এখনো দেশের চিরাচরিত বিজ্ঞাপন মাধ্যম এবং টেক কোম্পানিগুলোর মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা রয়েই গেছে।

 

অসম কর ব্যবস্থা এখনো বহাল আছে

 

ধরুন, একজন বিজ্ঞাপনদাতা বিপরীত স্রোত- ১০০,০০০ টাকার বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। বিপরীত স্রোত বিজ্ঞাপন বিল ইস্যু করার সময় ১৫ শতাংশ মূসক যোগ করে মোট ১১৫,০০০ টাকা উক্ত বিজ্ঞাপনদাতাকে কোম্পানিকে দাখিল করেছে।

 

যখন বিজ্ঞাপনদাতা বিপরীত স্রোত-কে বিল পরিশোধ করবে তখন প্রথমে মূসক বাবদ ১৫,০০০ টাকা উৎসে কর্তন করবে এবং তারপর ১০০,০০০ টাকা থেকে শতাংশ হিসেবে ,০০০ কর্তন করে বাকি ৯৫,০০০ টাকা বিপরীত স্রোত-কে পরিশোধ করবে।

 

অন্যদিকে ফেসবুক- একই বিজ্ঞাপনদাতা ১০০,০০০ টাকার বিজ্ঞাপন দিলে অনলাইনে ফেইসবুক বিজ্ঞাপনদাতার কাছ থেকে ১১৫,০০০ টাকা কেটে নিবে। মূসক বাবদ ১৫,০০০ টাকা সরকারি কোষাঘারে জমা দেবে আর বাকি ১০০,০০০ টাকা সম্পূর্ণ ফেসবুক নিয়ে নিবে। তার ফল হচ্ছে, বিপরীত স্রোত ,০০০ টাকা এখনো কম পাচ্ছে। তাই অসম কর ব্যবস্থা রয়েই গেছে। এজন্য এই টেক কোম্পানিগুলোকেও আয়করের আওতায় আনতে হবে।

 

টেক কোম্পানিকে কীভাবে আয়করের আওতায় আনা যাবে?

 

বর্তমানে ফেসবুক, গুগল তাদের মূসক প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রতিমাসে মূসক রিটার্ন দাখিল করে থাকে। যেহেতু এই প্রতিষ্ঠানগুলো মূল্য সংযোজন কর এবং সম্পূরক শুল্ক আইন মেনে মূসক দিচ্ছে তাই একই রকম ব্যবস্থা যদি আয়কর অধ্যাদেশে রাখা হয় তাহলে টেক কোম্পানিগুলোকেও খুব সহজেই আয়কর প্রদানের আওতায় আনা যাবে।

 

তবে বিষয়টা একটু জটিল কিন্তু অসাধ্য না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড টেকনিক্যাল বিষয়ে দেশের আইটি বিসেষজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারে। আর কীভাবে আয়করের বিষয়টি অধ্যাদেশে নিয়ে আসা যায় তার জন্য বিভিন্ন প্রফেশনাল বডি, যেমন দি ইন্সটিটিউট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অফ বাংলাদেশ (আইসিএবি) কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারে।

 

আমাদের আগে থেকেই বিভিন্ন দেশ ডিজিটাল সার্ভিসেস ট্যাক্স (ডিএসটি) বাস্তবায়ন শুরু করেছে। যারা আগে থেকেই এই কর ব্যবস্থা চালু করেছে তাদের আইনগুলো পর্যালোচনা করলে বিষয়টা আরো সহজভাবে করা যাবে।

 

কোথায় ডিজিটাল সার্ভিসেস ট্যাক্স রয়েছে?

 

ইতোমধ্যেই অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, ইটালি, পোল্যান্ড, স্পেন, তুরস্ক এবং যুক্ত্ররাজ্য ডিএসটি চালু করেছে। এই কর ব্যবস্থার উপর বেলজিয়াম, চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভাকিয়া প্রস্তাব পাস করেছে। আলোচনার পর তারা এই ব্যবস্থা কার্যকর করবে।

 

আর লাটভিয়া, নরওয়ে এবং স্লোভেনিয়া এই কর ব্যবস্থা তাদের দেশে কার্যকর করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

 

তবে আস্ট্রেলিয়া ২০২০ সালে একেবারে নতুন এক কর ব্যবস্থার কথা সামনে নিয়ে আসে যা প্রতিটা দেশের মিডিয়া হাউজগুলো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। আইন পাস করে গুগল, ফেসবুক জাতীয় প্ল্যাটফর্মগুলোকে করের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করতে আস্ট্রেলিয়া উদ্যোগ নিতে যাচ্ছিল। বিষয়টা হলো, প্রিন্ট মিডিয়া বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর ফেসবুক, গুগল তাদের নিউজ ফিড- শেয়ার হচ্ছে এবং তাদের ইউজাররা এই খবরগুলো পড়ছেন। এতে করে গুগল, ফেসবুক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হলেও মূল নিউজ এজেন্সি কিন্তু লাভবান হচ্ছে না। দিনে দিনে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারণে তাদের অবস্থা নাজুক হচ্ছে।

যখন অস্ট্রেলিয়াতে এই কর ব্যবস্থার কথা যুক্ত করা হচ্ছিল তখন গুগল থেকে বলা হয় তারা তাদের ব্যবসা অস্ট্রেলিয়া থেকে গুটিয়ে নেবে। কিন্তু এই হুমকি অস্ট্রেলিয়া গুরুত্ব দেয় নি।

এর ফলে দুটি বড় সুবিধা হতো। 

এক. দেশের মিডিয়া হাউজগুলো টেক কোম্পানি থেকে রয়্যালটি পেতো যার ফলে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা মজবুত হতো। 

দুই. দেশের সরকার তা থেকে রাজস্ব পেতো।

 

তবে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের মিডিয়া হাউজগুলো টেক কোম্পানিগুলো যে কর সুবিধা পাচ্ছিলো তা পরিহার করে তাদের উপরেও সমান হারে কর ব্যবস্থা চালু করার দাবি উঠে। কয়েক বছর পরে ২০২১ সালে মূসক প্রদান শুরু হলেও দেশি মিডিয়ার মতো আয়কর প্রদান করার বিষয়টি আর বাস্তবায়িত হয় নি।

 


আয়করের হার কতো হবে এবং কখন দিতে হবে?

 

এখন পর্যন্ত যে দেশগুলো ডিএসটি বাস্তবায়ন করেছে তার হার একেক দেশে একেক রকম, . শতাংশ থেকে . শতাংশ পর্যন্ত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এই সীমার মধ্যে যে কোনো হার নির্ধারণ করতে পারে। তবে এই কর হার নির্ধারণ হয় মোট প্রাপ্তির উপর।

 

আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-তে ৮২সি ধারায় ন্যূনতম কর উল্লেখ রয়েছে। এই ধারায় একজন করদাতা মোট প্রাপ্তির উপর সর্বোচ্চ শতাংশ হারে মোবাইল ফোন অপারেটর ন্যূনতম কর দিয়ে থাকে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এই হারে টেক কোম্পানিগুলোর জন্য ডিএসটি নির্ধারণ করতে পারে।

 

এখন প্রশ্ন হলো, কখন টেক কোম্পানিগুলো এই হারে কর দেওয়ার জন্য প্রযোজ্য হবে?

 

বেশির ভাগ দেশই যদি কোনো কোম্পানির বিশ্বব্যাপী আয় ৭৫ কোটি ইউরো এবং উল্লিখিত দেশ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আয় প্রাপ্ত হয় তাহলেই কেবল ওই কোম্পানিকে নির্ধারিত হারে ডিএসটি দিতে হয়।

 

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ থেকে ২৫ কোটি টাকা আয় অর্জিত হলে উক্ত কোম্পানি শতাংশ হারে ডিএসটি দেওয়ার জন্য প্রস্তাব করা যেতে পারে। এখন দেখা গেল, গুগল বিশ্বব্যাপী হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি আয় করেছে কিন্তু বাংলাদেশ থেকে তার আয়ের পরিমাণ ২৫ কোটি টাকার নিচে তাহলে গুগলকে বাংলাদেশে কোনো কর দিতে হবে না।

 

ডিজিটাল সার্ভিসেস ট্যাক্স কেন গুরুত্বপূর্ণ?

 

করোনাভাইরাস শুরুর আগে থেকে অনলাইনে লেনদেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও করোনাভাইরাসের সময় মানুষ যখন ঘরে বন্দী হয়ে যায় তখন তা ব্যাপক আকার ধারণ করে। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য অনলাইনে বৃদ্ধি পাওয়াতে অনেক দেশই তখন সরকারের রাজস্ব আহরণের এক নতুন ক্ষেত্রে খুঁজে পায়। অর্থনৈতিক স্থবিরতার সময় সরকার এক নতুন আশা দেখতে পায়।

বাংলাদেশ সরকারও বিগত কয়েক বছর ধরে বাজেটের আকার বৃদ্ধি করে চলেছে এবং পাশাপাশি বৈদেশিক নির্ভরতা কমিয়ে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন ক্ষেত্র এবং করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কীভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-কে আরো যুগপযোগী এবং আধুনিক করা যায় সেদিকেও মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে।

 

এমন অবস্থায় ডিএসটি বাংলাদেশের জন্য রাজস্ব আহরণের এক অন্যতম ক্ষেত্র হতে পারে। এতে করে একদিকে যেমন সরকারের রাজস্ব আহরণ বাড়বে তেমনি দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ পাবে।

jasim.uddin@taxpertbd.com


ক্যাটেগরিঃ অর্থনীতি,


জসীম উদ্দিন রাসেল

চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও লিড ট্যাক্স কনসালট্যান্ট, ট্যাক্সপার্ট



আরো পড়ুন