মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
‘শুভঙ্করের ফাঁকি’তে বেহাত শত কোটি টাকা
সমকাল, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১
পরিবহণ ভাড়া বেড়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়ে
যুগান্তর, ১৪ নভেম্বর ২০২১
কানাডায় এক্সপ্রেস এন্ট্রিতে শুভঙ্করের ফাঁকি!
রাইজিং বিডি ডটকম, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
বিদ্যুৎ বিল আদায়ে শুভঙ্করের ফাঁকি
ডেইলি বাংলাদেশ, ২ মার্চ ২০২০
মোবাইলে কলড্রপ ক্ষতিপূরণে শুভঙ্করের ফাঁকি
বর্তমান, কলকাতা, ২০ অক্টোবর ২০১৪
ঢাকা ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম এগুলো। ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ বাগধারাটি দিয়ে প্রতারণা করা, ফাঁকি বা ধোঁকা দেয়া বোঝায়। এর অর্থ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, “হিসেব নিকেশের মারপ্যাঁচে আসল বিষয় রেখে কর্তৃপক্ষ কিংবা সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে ফায়দা হাসিল করার কৌশলকে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ বলা হয়ে থাকে।”
কারো মনে প্রশ্ন হতে পারে, কে এই শুভঙ্কর? তিনি কী এমন ধোঁকা দিয়েছিলেন যে যুগের পর যুগ ধরে তাকে একজন ধোঁকাবাজ, ফাঁকিবাজের প্রতিভূ হিসেবে দেখা হয়?
বাংলার ইতিহাস আমাদের অন্য তথ্য দেয়। এখানে যে শুভঙ্করের কথা জানা যায় তিনি এক অসাধারণ মেধাবী গণিতবিদ। যিনি খুবই সহজ ভাষায় রূপক ব্যবহার করে গণিতকে বোধগম্য করে তোলেন। তিনি আর্যার মাধ্যমে অনেক জটিল অংকের সমাধান দিয়েছেন। এতে তার সাহিত্যজ্ঞানেরও প্রকাশ ঘটে। তিনি শুভঙ্করী পাটিগণিতের স্রষ্টা।
১৮৫৫ সালে ইংরেজ শিক্ষাবিদ ও ধর্মপ্রচারক রেভারেন্ড জেমস লং লিখেছেন, ‘শুভঙ্কর নামের জনৈক কায়স্থের দ্বারা ছন্দোবদ্ধ সূত্রে গাঁথা সাধারণ গাণিতিক নিয়মগুলো গত দেড়শ বছর ধরে প্রায় চল্লিশ হাজার বাংলা পাঠশালা মুখরিত করে রেখেছে।’
একজন গণিতবিদদের গাণিতিক সূত্র যখন দেড়শ ধরে চল্লিশ হাজার পাঠশালায় পড়ানো হয় তবে তাকে আর যাই হোক সাধারণ গণিতবিদ বলা যায় না। শুভঙ্করের লেখা ‘ছত্রিশ কারখানা’ বইটিতে ছিল দুই হাজারেরও বেশি গণিত সূত্র। বাংলার পাঠশালায় শুভঙ্করের বই ছিল শিক্ষকদের প্রথম পছন্দ।
কলকাতায় কীর্তিচন্দ্র দেবশর্ম্মা ‘মনোগণিত’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন ১৮৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে। বইটিতে তিনি শুভঙ্করী অংকের ব্যবহার বাড়ানোর বিষয়ে ইংরেজ প্রশাসকের সম্মতির বিষয়টি তুলে ধরেন। এ বিষয়ে তার বক্তব্য ছিল এমন, ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা অংকের যে সূত্র ব্যবহার করে তাতে গণিতের সমাধানে অনেক সময় চলে যায় এবং তা জটিল। পাঠশালাগুলোতে প্রাচীন গণিতবিদ্যায় অভিজ্ঞ গুরুগণ শুভঙ্করী পদ্ধতিতে শিক্ষা দিয়ে অনেক দ্রুত সেটির সমাধান করেন। ফলে তৎকালীন ইংরেজ প্রশাসক বাংলা স্কুলগুলোতে শুভঙ্করী পদ্ধতিতে গণিত শেখানোর নির্দেশনা দেন।
কীর্তিচন্দ্র দেবশর্ম্মা রচিত মনোগণিত বইয়ে শুভঙ্করের গণিত সূত্র নিয়ে লেখা
কে
ছিলেন এই শুভঙ্কর? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যায় নানা তথ্য। ইতিহাসবিদ ড. সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত বাংলাপিডিয়া জানাচ্ছে, ‘‘আক্ষরিক অর্থে শুভঙ্করী বলতে গণিত বিষয়ক গ্রন্থকে বোঝায়, যা গণশিক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। ... নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, বাংলার মধ্যযুগে শুভঙ্কর নামে একজন গণিতবিদ ছিলেন, যিনি লোকতোষ ছন্দের আকারে গণিত সংক্রান্ত কতকগুলি বিধি (আর্যা) প্রণয়ন করেছিলেন। তিনি প্রধানত মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষায় বিধি বা আর্যাগুলি প্রণয়ন করেছিলেন, যার মধ্যে প্রাকৃত,
অপভ্রংশ,
অবহট্ট ও অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা থেকে ধার করা বহু শব্দের সমাবেশ ঘটেছিল।”
মানসাঙ্ক বা মৌখিক গণিতের অসাধারণ ধারার জন্ম দিয়েছিলেন শুভঙ্কর। আগে ক্যালকুলেটর ছিল না। মানসাঙ্ক বা মুখে মুখে বড় বড় অঙ্ক কষায় দক্ষতা ছিল এই গণিতবিদের। এই মানসাঙ্কের সাহায্যে তিনি শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক গণিতের পাশাপাশি জমির পরিমাণ, জিনিসের দাম, রাজস্ব সংক্রান্ত জটিল হিসাব কবিতার ছন্দে সহজ ভাষায় প্রকাশ করতেন। যা মানুষ সহজে মনে রাখতে পারতেন এবং এসব সূত্র ব্যবহারিক কাজে প্রয়োগ করতেন। তার কয়েকটি আর্যার উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। তিনশ বছর আগে ছোটদের অঙ্ক শেখাতে তিনি অসাধারণ ছড়া তৈরি করেছিলেন:
সরোবরে বিকশিত কমল নিকর।
মধুলোভে এল তথা অনেক ভ্রমর।
প্রতি পদ্মে বসি ভ্রমর যুগল।
অলিহীন রহে তবে একটি কমল।
একেক ভ্রমর বসে প্রত্যেক কমলে।
বাকি রহে এক অলি, সংখ্যা দেহ বলে।
এর
অর্থ, একটি জলাধারে কমল বা পদ্ম ফুল ফুটে আছে। সেখানে মধু সংগ্রহে কয়েকটি অলি, ভ্রমর বা মৌমাছি এলো। প্রতিটি পদ্মে দুইটি করে মৌমাছি বসলো। এতে একটি পদ্ম ফাঁকা রইলো। বলতে হবে মৌমাছি ও পদ্ম সংখ্যা।
এই
মানসাঙ্কের আধুনিক পদ্ধতিতে সমাধান করলে দাঁড়ায়:
পদ্ম সংখ্যা X এবং ভ্রমর সংখ্যা Y হলে
Y =2 ( X-1)...(1)
Y=X+1…(2)
(1) এবং (2) সমাধান করে
X =3, Y =4
অর্থাৎ সরোবরে ৩ টি পদ্ম ছিল এবং ৪ টি ভ্রমর এসেছিল।
শুভঙ্করের একটি জনপ্রিয় আর্যা জমির মাপের জন্য শত শত বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গ্রাম বাংলায় এখনো এটি ব্যবহার করা হয়।
কুড়বা কুড়বা কুড়বা লিহ্যে
কাঠায় কুড়বা কাঠায় লিহ্যে
কাঠায় কাঠায় ধূল পরিমাণ
বিশ গণ্ডায় হয় কাঠার প্রমাণ
গণ্ডা বাকি থাকে যদি কাঠা নিলে পরে
ষোল দিয়ে পুরি তারে সারা গণ্ডা ধরে
আর্যাটির অর্থ কুড়বা দিয়ে কুড়বাকে গুণ করলে হবে বর্গ কুড়বা, কাঠাকে কুড়বা দিয়ে গুণ করলে বর্গ কাঠা, কাঠাকে কাঠা দিয়ে গুণ করলে পাওয়া যাবে ধূল যা ২০ বর্গ কাঠার সমান, অবশিষ্টকে (যদি থাকে) ১৬ দিয়ে গুণ করলে বর্গ গণ্ডা বের হয়।
শুভঙ্কর হাজারো মানসাঙ্কের মাধ্যমে শিক্ষা দিতেন। আরেকটি নমুনা এমন:
ত্রিশ হাত উচ্চ বৃক্ষ ছিল এক স্থানে
চূঁড়ায় উঠিবে এক কীট করে মনে।
দিবাভাগে দশ হাত উঠিতে লাগিলো
নিশাযোগে অষ্ট হাত নীচেতে নামিলো
না
পায় যাবৎ চূড়া করে সে অটন
কত
দিনে উঠেছিল কর নিরূপণ!
ত্রিশ হাত উঁচু একটি গাছের শীর্ষে যেতে এক কীট মনস্থির করে। দিনে সে দশ হাত উঠলেও রাতে আট হাত নেমে যায়। কতো সময়ে কীটটি গাছের উপরে যেতে পারবে?
উত্তরে যা পাওয়া যায়, এখানে কীটটি পুরো দিন ও রাত ২৪ ঘণ্টায় গাছের মোট দু’হাত উঠে। তার উঠার শেষ দিকে দিনের বেলা শেষ দশ হাত উঠলে চূড়ান্ত উঠা হবে। সে রাতে কীঠটি আর নিচে নামবে না। বাকি (বিশ) হাত কীট উঠা-নামা করেছিল ১০ দিন। অতএব, মোট সময় লাগবে দিন রাত মিলে পুরো ১০ দিন + একটি দিবাভাগ।
শুভঙ্করের পুরো নাম ছিল শুভঙ্কর দাস। তার সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে জানা যায়, তিনি পশ্চিমবঙ্গের বাকুঁড়াতে জন্মেছিলেন। তিনি একজন জনদরদী মানুষ ছিলেন। বাকুঁড়ায় একটি জলাধার খননে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এর নাম ‘শুভঙ্করী দাঁড়া’। বিভিন্ন সূত্র থেকে শুভঙ্করের আরো যে পরিচয় পাওয়া যায় তা হলো:
শুভঙ্কর একজন বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ও শুভঙ্করী নামক পাটিগণিতের রচয়িতা। বঙ্গদেশে কায়স্থ বংশে তার জন্ম। গণিতবিদ্যায় তিনি নিত্য-ব্যবহার্য অঙ্কসমূহ সমাধান করার সহজ সরল সঙ্কেত নির্ধারণ করে জনসাধারণের অশেষ উপকার করে গেছেন।
সরল বাঙ্গালা অভিধান: সুবলচন্দ্র মিত্র (১৮৭২-১৯১৩) সম্পাদিত
শুভঙ্কর ছিলেন একজন বিখ্যাত মানসাঙ্কবেত্তা। অঙ্কের কঠিন নিয়ম সংক্ষিপ্তভাবে সুললিত ভাষায় হৃদয়গ্রাহী কবিতার ছন্দে প্রকাশ করেছিলেন তিনি। ঐ ছন্দোবদ্ধ নিয়মগুলোই আর্যা নামে পরিচিত। তার আসল নাম শুভঙ্কর দাস। তিনি জাতিতে কায়স্থ ছিলেন বলে জানা যায়। নবাবি আমলে অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রাজকীয় বিভিন্ন বিভাগে কী রূপ বন্দোবস্ত ছিল এবং কী নিয়মে নবাব সরকারের কাজকর্ম পরিচালিত হতো তা শুভঙ্কর দাস তার লেখা ‘ছত্রিশ কারখানা’ নামক পুস্তকে বিবৃত করেছেন। ‘ছত্রিশ কারখানা’ পুস্তকে দুই হাজার শ্লোক ছিল বলে জানা যায়৷ এতে বহু ফারসি শব্দ আছে। তার অঙ্কশাস্ত্রের নাম শুভঙ্করী।
বিশ্বকোষ, নগেন্দ্রনাথ বসু (১৮৬৬-১৯৩৮) সম্পাদিত ও সংকলিত
সুবোধকুমার মুখোপাধ্যায় তার ‘প্রাক-পলাশী বাংলা’ বইয়ে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে মুখে মুখে অঙ্ক শেখানোর রেওয়াজ শুভঙ্করের আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। শুভঙ্কর তার অতি পরিচিত মানসাঙ্কের ছড়াগুলো এ রেওয়াজকে আরো সুন্দরভাবে সুগঠিত রূপ দিয়েছে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশীর যুদ্ধের আগেও বাংলাদেশে ছাত্ররা শুভঙ্করের আর্যা মুখস্থ করতো বলে জানা যায়।
মানসাঙ্ক বা মেন্টাল অ্যারিথম্যাটিককে জনপ্রিয় এবং লালন করা শুভঙ্করের মতো মেধাবী গণিতজ্ঞ শুধু বাংলা নয়, বিশ্বে বিরল। তিনি সহজ ছড়া এবং বোধগম্য ভাষায় সাধারণ মানুষের উপযোগী করে এই গণিতের সূত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। ইংরেজি শিক্ষায় মোহগ্রস্ত তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তিগণ সাধারণ শ্রেণীর নাম দিয়েছিলেন ‘ইতর শ্রেণী’ বা ‘নিম্ন শ্রেণী’। এ অঞ্চলে যখন ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ঘটানোর চেষ্টা শুরু হয় তখন ইংরেজদের পাশাপাশি এই মোহগ্রস্ত শ্রেণীটি নিজ দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই সোচ্চার হন। তারা অনেকে বলতে থাকে শুভঙ্কর ফাঁকি বা গোঁজামিল দিয়ে গণিত মেলান। বাংলার প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থাকে অর্থহীন প্রমাণ করতে এ ধরনের প্রচারণা ব্যাপক ভাবে শুরু হয়। এই কথা যখন চালু হয় তার বহু আগেই শুভঙ্কর মারা গিয়েছেন। একটি মিথ্যা অপবাদ যুগের পর যুগ ধরে শুভঙ্করের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে অন্যায় ভাবে।
শুভঙ্কর ফাঁকিবাজ বা প্রতারক কিছুই ছিলেন না। শুভঙ্কর ফাঁকি দেন নি। তার মতো অসামান্য গণিতবিদকে যেভাবে অবমূল্যায়ন এবং অপবাদ দেয়া হয়েছে শত বছর পেরিয়ে গেলেও তা থেকে ফিরে আসা প্রয়োজন। শুভঙ্করের প্রকৃত সম্মান ফিরিয়ে দিয়ে আমাদের উচিত ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ বাগধারাটি আর ব্যবহার না করা। বাংলার শ্রেষ্ঠ গণিতবিদদের তালিকায় শুভঙ্কর দাসের নাম সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত করা আমাদের দায়িত্ব।
বাংলার আদি শিক্ষা ব্যবস্থা বদলে ইংরেজদের অনুগত থাকার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তক লর্ড ম্যাকলে। তিনি যে কৌশলে বাংলার প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়েছেন সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ফাঁকি। তাই ফাঁকির কথা যদি বলতেই হয় তবে সেটা শুভঙ্করের ফাঁকি নয়, এর নাম দেয়া উচিত 'ম্যাকলের ফাঁকি'।
প্রথম প্রকাশ: মানবজমিন, ঈদ সংখ্যা ২০২২
সম্পাদক, বিপরীত স্রোত। সাংবাদিক ও গবেষক। অ্যাসোসিয়েট ফেলো, রয়াল হিস্টোরিকাল সোসাইটি।
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত
বাতিলযোগ্য সাইবার নিরাপত্তা আই.. বিস্তারিত
বাংলাদেশ তখনো বিশ্ব ক্রিকেট অঙ.. বিস্তারিত
ব্রেদিং আউট বার্ডেন নামে কর্ম.. বিস্তারিত