সাজেদ ফাতেমী
বারডেমের হিমঘরে রাখা হয়েছে কবি ও চিত্রশিল্পী বন্ধু ডঃ মোহাম্মদ ইলতেমাসকে। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের আহাজারি ও আর্ত চিৎকার চলছে করিডোর জুড়ে। চেয়ারে বসে পাথরের মতো স্থির অপলক অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে আছেন তার স্ত্রী। যেন ধ্যানে বসেছেন। আর ইলতেমাসকে ঘিরে অন্য সবার মাতম চলছে। ১৭ জুলাই ২০২২ রাতে এমনই এক পরিস্থিতির মধ্যে পৃথিবীর সব কান্না যেন আছড়ে পড়ছিল বারডেমে। কিন্তু কোনো কান্নাই ইলতেমাসকে স্পর্শ করছিল না। সেই কান্না বাড়িতে অসুস্থ হয়ে শুয়ে থাকা ৩ বছর ৪ মাস বয়সী মেয়ে ইবাদা আবিহার কানেও পৌঁছেনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২তম ব্যাচে বাংলা বিভাগে আমার সহপাঠী ছিলেন
ইলতেমাস। তার কিডনি-অসুস্থতার কথা জানিয়ে ফেসবুকে প্রথম স্ট্যাটাস দেই ২০১৩ সালের ৪ এপ্রিল। তখন ওর দুটো কিডনি নষ্ট হওয়ার পথে ছিল। আগস্ট নাগাদ দুটোই বিকল হয়ে যায়। এ অবস্থায় ২৭ আগস্ট বারডেম হাসপাতালে সেজো ভাইয়ের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় ইলতেমাসের শরীরে। এরপর একটানা প্রায় সাড়ে সাত বছর স্থিতিশীল ও স্বাভাবিক ছিলেন আমার বন্ধু।
অতি সাবধানতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হন ইলতেমাস। এরপর কোভিড-পরবর্তী কিডনি জটিলতা দেখা দেয়। রক্তের ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিন লেভেল বাড়তে থাকে। এ সময়ে তিনি বারডেমে ফলোআপে থাকার পাশাপাশি কিডনি ফাউন্ডেশনসহ কয়েকজন কিডনি বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা গ্রহণ করেন। কিন্তু কিডনির অবস্থা ক্রনিক রিজেকশনের দিকে চলে যায়। এ সময় শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তার ডায়ালাইসিস শুরু করতে হয়। ২০২১ সালের জুলাইয়ে পাঁচদিন, আগস্টে সাতদিন এবং সেপ্টেম্বরে কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হয় তাকে। সেপ্টেম্বরে হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালে ক্রিয়েটিনিন লেভেল ৯.৮ হওয়ায় গলায় ক্যাথেডার করে ডায়ালাইসিস চালাতে হয়। তখন অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। শরীরে অনেক পানি/ফ্লুয়িড জমে, রক্তের এলবুমিন, হিমোগ্লোবিন ও প্লাটিলেট আশংকাজনকহারে কমে যায়।
কোভিড-পরবর্তী কিডনি জটিলতা ও শরীরের সিরাম ইলেকট্রোলাইটস কমে যাওয়ায় ইলতেমাসকে গত ৩ জুলাই বারডেমে আবার ভর্তি করা হয়। একটু সুস্থ হলে ৭ জুলাই তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঈদের আগের দিন ও ঈদের দিন ডায়ালাইসিস বন্ধ থাকায় তার শ্বাসকষ্ট
বেড়ে যায়। হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লে ১০ জুলাই ঈদের দিন সন্ধ্যায় আবারও তাকে বারডেম হাসপাতালে নেয়া হয়। সর্বশেষ ১৭ জুলাই সন্ধ্যায় কোমায় চলে যান আমাদের পরম প্রিয় বন্ধু। তখনো পর্যন্ত তিনি আমাদের মাঝে আশার প্রদীপটি জ্বালিয়েই
রেখেছিলেন। কিন্তু কোরোসিন শেষ হয়ে যাওয়া একেবারেই নিভু নিভু প্রদীপটি আর কতোক্ষণই বা আলো দিতে পারে? ইলতেমাসও আর পারলেন না। রাত ৯টা ৩০ মিনিটে জীবন থেকে ছুটি নিলেন আমার পরম প্রিয় বন্ধুটি। বেঁচে থাকার জন্য দীর্ঘ প্রায় ১০ বছরের সংগ্রামের অবসান হয়।
করোনায় দুইবার আক্রান্ত হয়েছেন এবং লাইফ সাপোর্ট থেকে দুইবার ফিরেছেন ইলতেমাস। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারলেন না। করোনার কঠিন মহামারিকালে ২০২০-এর এপ্রিলে করোনা নিয়ে এক দুর্দান্ত লিরিক লিখে ফেলেন ইলতেমাস। ফেসবুকের দেয়াল থেকে নেয়া সেই লিরিকে তার অনুমতিসাপেক্ষে সুরারোপ করে টেলিভিশনে গান করেছি আমি। লিরিকটি এমন-
‘কঠিন সময় আজকে তোমায় ডাকে
সঙ্গনিরোধ নাম দিয়েছো যাকে।
মিথস্ক্রিয়ায় দিচ্ছো কিনা আড়ি
নইলে ঘাতক আসবে তোমার বাড়ি।’
রোনাজারি বিফল হবে শুধু
সামলে রাখো মনের আজব খেয়াল
জগৎ কী চাও মানববিহীন ধুধু
ভাঙো মেকি ভালোবাসার দেয়াল।।
নাইবা হলো বসন্ত দিন যাপন
ঝরা পাতায় লগ্ন আঁকি নেবার
থাকুক হিসেব কে পর কেবা আপন
সভ্যতারই ভীষণ অসুখ এবার।।
ইলতেমাস নিজের অসুখের চেয়ে সভ্যতার অসুখ নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। করোনার তাণ্ডব তাকে নিজের অসুখটা যেন ভুলিয়ে দিয়ে বিশ্ব মানবতার চিন্তায় মগ্ন করে দিয়েছিল। তাই তিনি বসন্ত দিন উদযাপনের কথা ভুলে গিয়ে ভালোবাসার মেকি দেয়াল ভাঙার চিন্তায় মত্ত হয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হলো না। সভ্যতার কঠিন অসুখ তাকেও গ্রাস করে ফেললো।
ইলতেমাস ছিলেন প্রকৃত বন্ধু। সব বন্ধুর মন জয় করা বন্ধু। তার বন্ধুপ্রীতির অনন্য এক গাথা লিখে গেছেন ফেসবুকের দেয়ালে। ২০২০ সালের ৩ আগস্ট তার সকল বন্ধুকে নিয়ে এক অনন্য কবিতা প্রকাশ করেছেন। সেই কবিতার শেষ অংশটুকুতে বন্ধুদের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা ও আস্থা ফুটে উঠেছে। কবিতার শিরোনাম দিয়েছেন ‘বন্ধু’। কবিতাটির শেষ ছয়টি চরণ-
‘বন্ধু ভালোবাসার তিলক চন্দনে
বন্ধু রে তুই শুভ্র হাসির ছন্দ নে!
ক্ষরণকালে নিবিড় প্রাণে পাশেই থাক
বন্ধু রে তুই এক ফোঁটা জল সামলে রাখ
মোর সমাধির রাখবি বেঁধে ফটোগ্রাফ
হৃৎকলমে লিখে রাখিস এপিটাফ!!’
ইলতেমাস, তুই ঠিক বলেছিস। আমরা তোর ক্ষরণকালে কিংবা আনন্দের কালে তোর পাশেই ছিলাম। বন্ধু, আমরা তোর সমাধির ফটোগ্রাফ বাধিয়ে রাখবো কিনা জানি না। তবে তোর এপিটাফ (সমাধি-লিপি) আজীবন থাকবে আমাদের অন্তরজুড়ে।
লেখক পরিচিতি:
সাজেদ ফাতেমী
ইলতেমাসের সহপাঠী
লিড ভোকালিস্ট, নকশীকাঁথা ব্যান্ড
জনসংযোগ পরিচালক, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
ই-মেইলঃ sajedfatemi1973@gmail.com
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত
বাতিলযোগ্য সাইবার নিরাপত্তা আই.. বিস্তারিত
বাংলাদেশ তখনো বিশ্ব ক্রিকেট অঙ.. বিস্তারিত
ব্রেদিং আউট বার্ডেন নামে কর্ম.. বিস্তারিত