বজলুল করিম আকন্দ
স্টিফেন উইলিয়াম হকিং-এর জন্ম ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে। তাঁর লেখা
এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম বইটি লন্ডন সানডে টাইমস-এ টানা ২৩৭ সপ্তাহ বেস্টসেলার তালিকায় ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই হকিংয়ের দুরারোগ্য মোটর নিউরন রোগ ধরা পড়ে। সে সময় চিকিৎসকেরা তাঁর আয়ু মাত্র কয়েক বছর বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু অদম্য মানসিক শক্তির জোরে তিনি পড়ালেখা ও গবেষণা চালিয়ে যান। দৈহিক অক্ষমতাকে জয় করে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের লুকাসিয়ান অধ্যাপক হিসেবে একটানা ৩০ বছর অধ্যাপনা করেছেন।
১৯৯৫ সাল, এ সময় আমি স্টিফেন হকিংয়ের লেখা-এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম বইটি সংগ্রহ করে পাঠ করি। তখন বইটির মর্মার্থ পুরোপুরি বুঝিনি। তবে কৌতূহলী হয়ে তাঁকে একটি পত্র লিখি (২৫ জুলাই, ১৯৯৫) এবং খুব দ্রুতই এর একটি জবাব পাই (২৫ আগস্ট, ১৯৯৫)। বইটির নামকরণ সার্থক হয়েছে। কারণ, এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম-মূলত স্থান-কাল অর্থাৎ আমাদের এ মহাবিশ্বেরই ইতিহাস। দু’ধরনের কাল রয়েছে-বাস্তব কাল ও কাল্পনিক কাল। বাস্তব কাল যদিও মনুষ্যসৃষ্ট তবু এর অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। বাস্তব কালে মহাবিশ্বের একটি শুরু আছে এবং সম্ভবত এর একটি শেষও আছে। যেমন, আমাদের মহাবিশ্বের বর্তমান বয়স ১৩.৭ বিলিয়ন বছর। আরেকটি কাল আছে তা হলো কাল্পনিক কাল। মহাকর্ষের কণাবাদী তত্ত্বে কাল্পনিক কালের সন্ধান মেলে। এ কালে মহাবিশ্বের শুরুও নেই শেষও নেই। এটি অনন্ত-অসীম। মহাবিশ্বের আদি অবস্থা বিজ্ঞানীদের জানা নেই ।
হকিং বিকিরণ
হকিং উপলব্ধি করেন-মহাবিশ্বের আদি অবস্থাকে বুঝতে কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে কাজ করা দরকার। তাই কৃষ্ণগহবর নিয়ে তিনি গবেষণা শুরু করেন। সূর্যের চেয়ে বেশি ভরের তারারা অন্তিম দশায় কৃষ্ণগহবরে পরিণত হয়। কৃষ্ণগহবরের মহাকর্ষীয় বল এতো বেশি যে এটি আশপাশের সবকিছু গ্রাস করে নেয়, এর থেকে আলোও বেরিয়ে আসতে পারে না। তাই একে শনাক্ত করা যায় না। হকিং দেখালেন, কৃষ্ণগহবরও বিকিরণ দেয়-একে বলে হকিং বিকিরণ। কৃষ্ণগহবর বিকিরণ দিয়ে দিয়ে একসময় মিলিয়ে যাবে। হকিং বিকিরণ তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণিত হলেও বাস্তবে এটি শনাক্ত হয়নি। তাই হকিংয়ের কপালে নোবেল পুরস্কার জোটেনি।
অধ্যাপক হকিং মহাবিশ্ব সম্পর্কে লিখেছেন, তাঁর লেখার বেশির ভাগই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যা লিখেছেন তার গুরুত্ব অনেক বেশি। তাঁর অনেক লেখাতেই মনে হয়-মানুষের পরস্পর হানাহানি এবং আগ্রাসনী প্রবৃত্তি রয়েছে মানুষের জিনে অর্থাৎ বংশগতিতে। তার ধারণা এ প্রবৃত্তি প্রোথিত রয়েছে জিনের গঠনে, এই আগ্রাসনী প্রবৃত্তি মানুষকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে এসেছে। এই জিনে যদি কোনো জীবনমুখী পরিবর্তন হয় তাহলেও তার জন্য একাধিক নিযুত বছর লাগতে পারে। অথচ মানুষের হাতে এখনই ব্যাপক ধ্বংস করতে পারে এ রকম অস্ত্র যে পরিমাণ আছে তার সাহায্যে মানব সভ্যতাই নয়, জীবনের সব রকম লক্ষণই পৃথিবী থেকে বহুবার মুছে দেয়া যেতে পারে। তথাকথিত ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হওয়াতে পরিস্থিতির বিশেষ কোনো উন্নতি হয়েছে বলে তাঁর মনে হয় না। এই গ্রহে মনুষ্যজাতির অস্তিত্ব রক্ষিত হওয়ার মতো দুটি পরিস্থিতি তিনি কল্পনা করেছেন: এই দু’পেয়ে জীবেরা যদি অন্য কোনো গ্রহে কিংবা উপগ্রহে উপনিবেশ স্থাপন করতে পারে তা হলে তাদের বংশধরদের সাহায্যে এই পার্থিব মনুষ্যজাতির বংশ রক্ষা করার একটা সম্ভাবনা থাকবে। আর মানুষের শুভবুদ্ধি যদি তার আগ্রাসী প্রবৃত্তিকে জয় করতে পারে তা হলেও মনুষ্যজাতির বিপদ মুক্ত হবে। হকিং আরও একধাপ এগিয়ে এলিয়েন বা ভিনগ্রহী জীবের অস্তিত্ব ও টাইম ট্র্যাভেল নিয়ে মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন; আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অদূরভবিষ্যতে মানুষকে বোকা বানাতে পারে বলেও হকিং সতর্ক করেছেন।
অধ্যাপক হকিং-এর মস্তিষ্কের সংবাদ সারা বিশ্বেরই জানা কিন্তু হৃদয়ের সংবাদ কি সবাই জানে? শারীরিক ভাবে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকার পরও অধ্যাপকের রয়েছে আকাশের মতো উদার একটি হৃদয়। তাঁর জীবনে বিফলতা এসেছে নিজের স্বাস্থ্যে, সাফল্য এসেছে কর্মে, ভালোবাসায়। তিনি ভালোবাসতে পেরেছেন ভালোবাসা পেয়েছেন। ১৯৯৫ সালে তাঁর সেবায় নিয়োজিত নার্স এলেন ম্যাসনের সঙ্গে তিপান্ন বছর বয়সে তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ সম্পন্ন হয়। কারণ, তাঁর অসুস্থতার জন্য তাঁর প্রথমা স্ত্রী জেন ওয়াইল্ড ১৯৯০ সাল থেকেই আলাদা বসবাস করতেন। ২০০৬ সালের দিকে নার্স এলেন ম্যাসনের সাথে সম্পর্কের ইতি টানেন তিনি। জেনের সাথে পুনরায় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। জেনের লেখা বই, ট্র্যাভেলিং টু ইনফিনিটি: মাই লাইফ উইথ স্টিফেন অবলম্বনে ২০১৪ সালে হকিংকে নিয়ে একটা চলচ্চিত্র-দ্য থিওরি অফ এবরিথিং তৈরি হয়। হকিং সেই চলচ্চিত্র দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন। হকিং এর ভূমিকায় এডি রেডমেইনকে দেখে তিনি মনে করেছিলেন যে, তিনি যেন নিজেকেই দেখতে পাচ্ছেন। চলচ্চিত্রটি সে সময় দর্শকনন্দিত হয়েছিল। আর এডি রেডমেইন একটা অস্কারও জিতে নিয়েছিলেন হকিং-এর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য।
২০১৮ সালের ১৪ মার্চ, স্টিফেন হকিং ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজে নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ছিয়াত্তর বছর। শেষকৃত্যের পর ২০১৮ সালের ১৫ জুন তাঁকে
ওয়েস্টমিনস্টার এ্যাবেতে তাঁর দুই বৈজ্ঞানিক নায়ক আইজ্যাক নিউটন আর চার্লস ডারউনের মাঝখানে সমাহিত করা হয়। আর তাঁকে যখন পৃথিবীতে শেষ বিশ্রামের জন্য শোয়ানো হয় তখন তাঁর কণ্ঠস্বর রেডিও টেলিস্কোপের মাধ্যমে রশ্মির আকারে একটা কৃষ্ণগহ্বরে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
লেখক
পরিচিতি: অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ।
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত
বাতিলযোগ্য সাইবার নিরাপত্তা আই.. বিস্তারিত
বাংলাদেশ তখনো বিশ্ব ক্রিকেট অঙ.. বিস্তারিত
ব্রেদিং আউট বার্ডেন নামে কর্ম.. বিস্তারিত