তহুরা জান্নাত
খুব তাড়াহুড়ো করে অনু ক্লাসে ঢুকলো। সে সব সময় দ্বিতীয় বেঞ্চে বসে। আজ বসতে যেয়ে দেখে, দোলন আর পাঁপড়ি বসে আছে। অনু দোলনকে ইশারায় পেছনের বেঞ্চে যেতে অনুরোধ করলো। দোলন যথারীতি অনুকে দেখে দুষ্টুমি শুরু করলো। অনেক অনুরোধের পর দোলন উঠে তৃতীয় বেঞ্চে চলে গেল। আজ তাইবুল স্যারের ক্লাস। রাশান ইতিহাস অনুর কাছে বেশ জটিল মনে হয়।
তাই স্যারের ক্লাসে অনু বেশ মনোযোগ দেয়। একটু পর পেছন থেকে দোলন কলম দিয়ে খোঁচা দিল। ফিসফিস করে বললো,
-অনু, এই অনু!!
-কী হয়েছে ? অনু আস্তে করে বললো।
-এই এটা নাও।
-কী নেবো?
-আরে নিলেই তো বুঝবা।
-
আচ্ছা দাও।বলে অনু হাত বাড়ালো।
দোলন একটা চিরকুট বাড়িয়ে ধরলো।
অনু চিরকুটটা হাতে নিল। এরপর ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো।
ক্লাস শেষ। অনু ব্যাগ থেকে চিরকুটটা বের করে খুলে পড়লো। পড়ে একটা মুচকি হাসি দিল। মনে মনে বললো, ফাজিলটার কান্ড দেখো! এইসব নিয়েও ফাজলামো করে। তারপর বান্ধবীদের সাথে গল্প করতে করতে কলা ভবন থেকে বেরিয়ে গেল।
পরের দিন কলা ভবনের বারান্দায় অনু দাঁড়িয়ে
আছে ক্লাসের অপেক্ষায় । দোলনও তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল বারান্দায়। অনুকে দেখে বলে উঠলো,উত্তর দিলে না যে?
অনু আকাশ থেকে পড়লো,কিসের উত্তর?
-কালকের চিঠির উত্তর!
অনু বেমালুম ভুলে বসে আছে চিঠির কথা।
-‘ও আচ্ছা’ বলে অনু ফিক করে হেসে ফেললো। দোলন বিরক্ত হয়ে বললো, হাসছো কেন?
অনু হাসি চাপা দেওয়ার জন্য ওড়না ঠোঁটে চাপা দিলো।দোলনের রাগ দেখলেও তার হাসি পায়। ও এতো মজার একটা ছেলে। সবকিছু নিয়ে সে মজা করে।
-কাল কিন্ত চা-ই-ই চাই।
দোলন একটু বিরক্ত হয়েই যেন বললো।
-আচ্ছা দিবো।অনু দোলনের চেহারার দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠলো।
পরের দিন বৃহস্পতিবার। ঢাকা চলে গেল অনু।
রবিবার
ফিরলো। যথারীতি কলা ভবনে ক্লাসে ঢোকার সময় এক্কেবারে পড়ল দোলনের সামনে । যেন অনুর অপেক্ষাতেই ছিল সে। আজও দোলনের এক কথা। উত্তর চাই।
অনু আশ্বাসের সুরে বললো, কাল দিবো ইনশা আল্লাহ।
সন্ধ্যায়,
হলে পড়তে বসে কিছুতেই পড়ায় মন বসলো না অনুর। দোলন খুবই দুষ্টু
একটা ছেলে। ওর কাজই হলো সব বিষয় নিয়ে মজা করা। ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসের দ্বিতীয় দিন থেকে সবাই জানে সিরিয়াসনেস বলে ওর মধ্যে কিছু নেই। অনুর দৃঢ় বিশ্বাস চিঠির উত্তর দোলন চাইছে, অবশ্যই মজা করার জন্য। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। একবার অবশ্য ক্ষণিকের জন্য অনুর মনে হলো চিঠিতে যা লিখা, সেটা সত্যি হতেও পারে। পরক্ষণে মনে হলো, দূর এ বিষয়কে সিরিয়াসলি নেয়ার কোনো কারণই নেই।
তবু একটা উত্তর দিতে হবে। নইলে আগামীকাল খবর করবে দোলন । ক্লাসই করতে দিবে না। ওর দুষ্টুমি আর কপট রাগ দেখিয়ে অস্থির করে তুলবে।
চিঠি লিখতে বসলো অনু
প্রিয় দোলন কুমার,
আপনার চিঠি পেয়েছি।বাড়িতে এত কাজ তাই উত্তর দিতে দেরি হলো। আমাদের...হাঁসের ছানাগুলো ভালো আছে। গরুটা কয়েকদিন যাবত খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। খালি আপনারে খুঁজে। কবে বাড়িতে আসবেন। ছেলেটার পেটে কৃমি। ডাক্তার দেখান লাগবো। তাড়াতাড়ি আসেন। ধান কাটার সময় হইছে। ধান উঠলে আমি কিন্ত বাপের বাড়ি যাব। আপনার কোনো কথা শুনব না। মনে থাকে যেন। আজ আর লিখতে পারব না। অনেক কাজ। ভালো থাকিয়েন।
ইতি
আপনার...।
পরের দিন দোলন কাছে আসতেই অনু চিঠিটা বাড়িয়ে দিল। ভীষণ পোংটা দোলনের চিঠির উত্তর দিয়ে বেশ মজা পাচ্ছে এখন। উত্তর দিয়েছে সে। হোক না সেটা হাবিজাবি টাইপের উত্তর।
একটু পর দোলন কে দেখলো চিঠিটা দলা পাকিয়ে হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুরছে। আরও দুই তিনজন বন্ধু ওকে ঘিরে ভীষণ হাসাহাসি করছে। দোলনের চোখে কপট রাগ।অনুর দিকে একবার তাকিয়ে সে ক্লাস না করেই বন্ধুদের সাথে চলে গেল।
দুই.
বছর তিনেক পর।
অনুদের মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে সপ্তাহব্যাপী অনুদের ব্যাচের সমাপনী অনুষ্ঠান। সন্ধ্যায় মুক্তমঞ্চে প্রোগ্রাম দেখতে বন্ধুদের সাথে অনু আসলো। কিছুক্ষণ দেখার পর অনুর কেন জানি ভীষণ মাথা ধরলো। এতো অসহ্য সাউন্ড। কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না তার। হলে যেতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্ত একা হলে যেতেও সাহস পাচ্ছে না। হলে যাওয়ার রাস্তাটার দুইপাশে ঘন জঙ্গল।ভয় পায় অনু।
মুক্তমঞ্চ
থেকে বেরিয়ে সে ক্যাফেটেরিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো।এই দিকে শব্দ কিছুটা কম।এই সময় দোলনকে দেখলো।ক্যাফেটেরিয়ার সামনে বন্ধুদের সাথে গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে।অনুকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দোলন চেঁচিয়ে ডাকলো অনুকে।
-এই অনু এই ।
-অনু দোলনের কাছে এসে দাঁড়ালো।এখন যেন অস্বস্তিকর অবস্হা থেকে সে বেরিয়ে আসলো। এতোক্ষণ খুব খারাপ লাগছিল একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে ।
-কী হয়েছে তোমার? দোলন কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলো।
-কিছু না।
-তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে কেন? চল আমার সাথে চল।
প্রোগ্রাম দেখবে।
-না, কেন যেন আজ সাউন্ড সহ্য হচ্ছে না।
প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।
-কী করবে তাহলে?
-হলে যাবো।
-আচ্ছা চলো। তোমাকে হলে দিয়ে আসি।
অনু মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। দোলন রিকশা ডাকলো। হলের গেটে অনুকে নামিয়ে দিতে যেয়ে বললো, চলো একটু হেঁটে আসি। আর সপ্তাহ খানেক পর কে কোথায় যাবো ঠিক নেই। আর দেখা হবে কবে? কি জানি? এ বিষয়টা ভাবতেই, দুজনই বিষন্ন হয়ে উঠলো। আসলেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার মতো কষ্টের সাথে আর অন্য কষ্টের তুলনা হতে পারে না।
অনু আর দোলন হাঁটছে। মার্চের প্রথম দিক। তবু সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাসে ঠাণ্ডা নেমে আসে। আজ একটু অন্ধকারই চারপাশটা। কিছুটা নিরবও। সব মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠান দেখছে।এদিকটা ভীষণ ফাঁকা।
এক নম্বর হলের সামনের মাঠে দুজন একটা বেঞ্চে বসলো।
-চা খাবে, অনু?
-হুম, খাওয়া যায়।
গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ে মনোনিবেশ করলো দুজনে। দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ বছরের জীবনে কতশত মজা করেছে, সেইসব গল্প বলা শুরু করলো অনুকে। আজ যেন তাকে কথায় পেয়ে বসেছে। এর
ফাঁকে হঠাৎ করেই, মজা করার জন্য, অনু হেসে বললো,
-তুমি কেমন মানুষ দোলন? বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করলে। অথচ একটা প্রেম করলে না। সারাদিন শুধু হৈ চৈ।আর মজা করা। এভাবেই পার করলে পাঁচটি বছর।
-তুমিও তো করলে না।
-না, হয়ে উঠলো না।
-কেন?
-বাসায়,আব্বু ফার্স্ট ইয়ার থেকেই বিয়ের জন্য প্রেশার দিচ্ছিল।তাই শুধু শুধু কারো মন নিয়ে খেলতে ইচ্ছে করেনি।
-ও আচ্ছা।আজ মনে হচ্ছে, চিঠির উত্তর পেলাম।
-কিসের চিঠি?
-কেন একবার একটা চিঠি তোমাকে লিখেছিলাম।
-হুমম,কিন্ত সেটা কি সত্যি ছিল? অনু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো।
-হ্যাঁ ছিল।
-কী বলো এসব! এতোদিন পর? অনুর গলার স্বর কেঁপে উঠলো।
-হ্যাঁ,অনু আজ আর বলতে কোনো দ্বিধা নেই। আজ আর কোনো উত্তরের ও প্রয়োজন নেই। এখন তুমি অন্যের বউ।
অনু, মাথা নিচু করে বসে থাকলো। কোনো উত্তর দিতে পারলো না। পারার কথাও না। তিনবছর আগে যে চিঠিতে লেখা ছিল "ভালোবাসি, ভী-ষ-ণ ভালোবাসি
"।
সব কিছু নিয়ে সবার সাথে মজা করা দোলনের চিঠিটাকে অনু মজাই ধরে নিয়েছিল।
সন্ধ্যা
ঘনিয়ে রাত নেমে এসেছে। ঠাণ্ডা যেন জাঁকিয়ে বসেছে। আকাশে ঘোলাটে চাঁদ। কুয়াশা ভেদ করে, মরা জোসনা চুঁইয়ে পড়ছে ওদের দুজনের উপর। পাশে বসে থাকা, সদা চঞ্চল, হৈ হুল্লোড় করা দোলন আজ এইমুহূর্তে ভীষণ চুপচাপ। যে কথা এতোদিন মুখ ফুটে বলতে পারেনি। সেটা বলতে পেরে আজ সে ভীষণ রকমের শান্ত।
কিছু ভালোবাসা হয়তো এভাবেই হারিয়ে যায়। শুধু থেকে যায়,বুকের মধ্যে হাহাকার।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সুবর্ণজয়ন্তী ও তৃতীয় পুনর্মিলনী উপলক্ষে লেখা গল্প।
লেখক পরিচিতি:
তহুরা জান্নাত
পেশাগত
জীবনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তহুরা জান্নাত বাংলাদেশ পুলিশের একজন সাহসী সদস্য হিসেবে কঙ্গোর কিনশাসায় জাতিসংঘ মিশনে অংশ নেন। লেখকের প্রকাশিত বই ‘কিনশাসার দিনগুলি’। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ২৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত
বাতিলযোগ্য সাইবার নিরাপত্তা আই.. বিস্তারিত
বাংলাদেশ তখনো বিশ্ব ক্রিকেট অঙ.. বিস্তারিত
ব্রেদিং আউট বার্ডেন নামে কর্ম.. বিস্তারিত