মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
পশ্চিমবঙ্গের লেখক, চলচ্চিত্র অধ্যাপক কল্লোল লাহিড়ীর লেখা উপন্যাস ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে। বইটির কাহিনী ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচই-য়ে তা সিরিজ হিসেবে প্রচারিত হওয়ার পর। শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায় সিরিজটিতে ইন্দুবালার চরিত্রে অভিনয় করেন। খুলনার মেয়ে ইন্দুবালা বিয়ের পর কলকাতায় তার স্বামীর ঘরে গেলেও সেখানে সুখ ছিল না। এর মধ্যে তার স্বামী মারা যান। দুই সন্তানকে নিয়ে শুরু হয় ইন্দুবালার সংগ্রাম। ছোট আকারে খোলেন ভাতের হোটেল। ধীরে ধীরে এর নাম হয়ে যায় ইন্দুবালা ভাতের হোটেল।
পাবনার জালালপুরে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল
এই কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশের পাবনা শহরের জালালপুরে বাস্তবেই যাত্রা শুরু করে ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’। উপন্যাসে বর্ণিত হারিয়ে যাওয়া কিছু দেশজ খাবারকে নতুন করে নিয়ে আসা, ভিন্ন ধরনের পরিবেশনা, খাবারের মান এবং কম দামের জন্য এরই মধ্যে হোটেলটির নাম শুধু পাবনা নয়, সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ খেতে আসেন এখানে।
কুমড়ো ফুলের বড়া,নারকেল দিয়ে কচু বাটা, বিউলির ডাল,কুমড়োর ছককা, সোনামুগের ডাল, আম দিয়ে ডাল, আম দিয়ে পাবদা মাছের ঝোল,আম–তেল, কচু ঘণ্টো, চিংড়ি ভর্তা, ছ্যাঁচড়া, চিংড়ির হলুদ গালা ঝোল, চন্দ্রপুলি, কচুবাটা’, মালপোয়া, শুক্তো-সহ নানা পদের খাবারের স্বাদ নিতে পারেন এখানে ভোজনরসিক থেকে শুরু করে নিয়মিত আগত ব্যক্তিগণ।
খাবার পরিবেশনের আগের প্রস্তুতি
উপন্যাসের কাহিনীর মতোই পাবনার ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের নেপথ্যে আছেন একজন নারী। তার নাম সোহানী হোসেন। কাহিনীর ইন্দুবালার সাথে বাস্তবের সোহানী হোসেনের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় অনেক পার্থক্য থাকলেও একটি জায়গায় দু’জনের প্রবল মিল রয়েছে। সেটি হলো, দুই ক্ষেত্রেই এটি এক
অদম্য নারীর একক সংগ্রামের কাহিনী।
‘টেস্টি স্যালাইন’ খ্যাত ইউনিভার্সাল গ্রুপের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহানী হোসেনকে তার পাঁচ মেয়ে নিয়ে জীবনের নতুন সংগ্রাম শুরু করতে হয় যখন ক্যান্সারে তার স্বামী উদ্যোক্তা ও জাতীয় পর্যায়ের চ্যাম্পিয়ন শুটার মোবারক হোসেন রত্নের মৃত্যু হয়। ২০০৭ সালে যখন মোবারক হোসেন রত্ন মারা যান তখন বড় মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে আর
ছোট মেয়ের বয়স দুইয়ের কিছু বেশি।
সিঙ্গাপুর থেকে যেদিন স্বামীর লাশ এসে পৌঁছে সেদিন ছিল বড় মেয়ের এসএসসির উচ্চতর গণিত পরীক্ষা।
অনেকেই মেয়েকে বলেছিলেন সেদিন পরীক্ষা না
দিয়ে এক বছর ড্রপ দিতে।
কিন্ত মা সোহানী হোসেনের অটল সিদ্ধান্তে মেয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসার পরই বাবার কফিন খোলা হয়। বিয়ের পর
ঘর সংসারে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া সোহানী হোসেনের এটিই ছিল পরিবারে প্রথম সাহসী পদক্ষেপ।
সোহানী হোসেনের জন্ম নাটোরে একটি সংস্কৃতিমনা পরিবারে ২২
জুন ১৯৬৬ সালে।
খেলাধুলা, সঙ্গীত, সামাজিক সংগঠন, ছাত্র রাজনীতি সব কিছুতেই ছিল তার পদচারণা। তার নানী এবং মা দুজনেই লেখালেখির সাথে জড়িত ছিলেন।
নারীদের পত্রিকা ‘বেগম’-এ নিয়মিত লিখতেন তারা। সোহানী হোসেন নিজেও ছবি আঁকার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে জড়িত।বিদায় ছুটিপুর, শূন্যরেখা, সমুদ্র তরঙ্গ, মন
শিথানে বৃষ্টি নামে অশ্রুধারা হয়ে, ভরা জোয় পঙতিমালা-সহ তার বেশ কয়েকটি কবিতা ও
গদ্যের বই আছে। ‘মা এবং অন্যান্য গল্প’ নামে সোহানী হোসেনের একটি গল্পের বই
প্রকাশিত হয়েছে। এই বইয়ের মা
গল্প নিয়ে ‘সত্তা’ নামে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেন তিনি।
মুভিটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের পাঁচটি শাখায় পুরস্কৃত হয়। সত্তা মুভিতে অভিনয় করেন শাকিব খান ও ভারতের পাওলি দাম। মুভিটিতে বাপ্পা মজুমদারের সুরে জেমসের গাওয়া ‘তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম/কী দোষ দিবি তাতে/ বন্ধু তোরে খুঁজে বেড়াই/সকাল দুপুর রাতে’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। গানটি লিখেছেন সোহানী হোসেন। বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে জেমস ও কভার করা শিল্পীদের কণ্ঠে গানটির সমবেত ভিউ দশ কোটিরও বেশি। গানটির জন্য জেমস জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত শিল্পী নির্বাচিত হন। একই গানের জন্য জেমস মেরিল-প্রথম আলো শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত শিল্পীর পুরস্কার জেতেন। গানটির জন্য দুবাইয়ে গ্লোবাল মিউজিক অ্যাওয়ার্ড পান গীতিকবি সোহানী হোসেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি-বাচসাস পুরস্কারজয়ী এই গানটিকে এবিসি রেডিও ২০১৭ সালে তাদের প্রচারিত সেরা ৫০
গানের তালিকায় এক
নাম্বারে রাখে। আর একই বছর ডেইলি স্টার সেরা ১০ বাংলা গানের তালিকায় তৃতীয় স্থানে রাখে গানটিকে। সত্তা মুভিটিতে স্থান পায় সঙ্গীত শিল্পী ও
সংসদ সদস্য মমতাজের গাওয়া আরেকটি সুপার হিট গান ‘না
জানি কোন অপরাধে/দিলা এমন জীবন/আমারে পুড়াইতে তোমার/এতো আয়োজন/আমারে ডুবাইতে তোমার/এতো আয়োজন।’
মুক্তির অপেক্ষায় থাকা শাকিব খান অভিনীত ‘অন্তরাত্মা’ নামে আরেকটি মুভির প্রযোজকও সোহানী হোসেন।
শাকিব খানের জন্মদিনে পাবনায় ব্যতিক্রমী আয়োজন করেন সোহানী হোসেন। এই আয়োজনে মুগ্ধ হয়ে শাকিব খান তার অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে জন্মদিনের ভিডিওর শিরোনাম দেন ‘শাকিব খানস মোস্ট সারপ্রাইজিং বার্থডে সেলিব্রেশন’।
শুধু সেলিব্রেটিদের জন্য নয়,
তার সাথে যারা কাজ করেন তাদের পাশে সব সময় দাঁড়ান বলে জানান সহকর্মীগণ। রূপকথা সিনেমা হলসহ পাবনা ও
এর আসেপাশে জেলায় কয়েকটি সিনেমা হলের মালিক ছিলেন সোহানী হোসেনের স্বামী মোবারক হোসেন রত্ন। সোহানী হোসেনের মালিকাধীন দুটো রিসোর্ট রত্নদ্বীপ ও
রূপকথা। পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজ করতে আসা রাশান নাগরিকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে রত্নদ্বীপ। স্বামীর নামে রাখা রত্নদ্বীপ তৈরিতে যে শ্রমিকরা অংশ নিয়েছিলেন তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন উদ্বোধনী আয়োজনে। কোনো বিশেষ অতিথি নয়, সোহানী হোসেন রত্নদ্বীপ উদ্বোধন করান সেই শ্রমিকদের দিয়ে। তাদের প্রিয় শিল্পী সালমাকে দিয়ে কনসার্ট করিয়ে রাতে রিসোর্টের প্রথম রাতটি আধুনিক রুমগুলোতে শ্রমিকদেরই থাকতে দেন তিনি। নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার হরিজন, হিজড়া, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে ভালোবাসেন সোহানী হোসেন। বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পাবনার বিখ্যাত ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সৎসঙ্ঘের অন্যতম সহযাত্রী তিনি।
সোহানী হোসেনের কাজে পরিকল্পনা ও রুচির ছাপ পাওয়া যায়। তার সহকর্মীরা বলেন, তিনি কোয়ালিটির বিষয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ করতে চান না। পাবনার কৃতিসন্তান সুচিত্রা সেনের অনুরক্ত তিনি। তার রূপকথা রিসোর্টের বিভিন্ন কটেজ ও বাংলোয় রুমগুলোর নামকরণ করেছেন সুচিত্রা সেন অভিনীত চলচ্চিত্রের নামানুসারে।
একজন উদ্যোক্তা সোহানী হোসেন পাবনায় মাশরুম চাষ করে আলোচনার জন্ম দেন। ব্যতিক্রমী উদ্যোগের কারণে তিনি পরিচিতি। পেয়েছেন অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রিসহ দেশি বিদেশি অনেক সম্মাননা।
প্রতিদিন এভাবে চক দিয়ে বোর্ডে খাবার মেনু লেখা হয়
পাবনার জালালপুরে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল তার সর্বশেষ উদ্যোগ। মাত্র এক মাস হলেও হোটেলটি এরই মধ্যে সম্ভবনাময় উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ইন্দুবালা ভাতের হোটেল ওটিটি সিরিজের মতোই এখানে বাংলার হারিয়ে যাওয়া খাবারগুলো স্টিলের থালায় কলাপাতার ওপর পরিবেশন করা হচ্ছে। প্রতিদিনের মেনু চক দিয়ে বোর্ডে লেখা হচ্ছে। ন্যূনতম ৮০-১২০ টাকার মধ্যে যে কেউ পেট পুরে তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারেন এখানে। হোটেলের নারী কমীরা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি ও পুরুষরা লাল টি শার্ট পরে পরিবেশন করছেন।
খাবারের অর্ডার নেয়া হচ্ছে
হোটেলের বাজার করা, রান্না ও
পরিবেশনা প্রতিটি ক্ষেত্রেই সোহানী হোসেনের সতর্ক নিয়ন্ত্রণ দেখা যায়।
প্রায় প্রতিদিনই তিনি নিজে রান্না করে থাকেন।
কয়েক হাজার কর্মী পরিচালনাকারী সোহানী হোসেন রান্নার কাজটি আনন্দের সঙ্গে করে থাকেন।
তিনি জানান, কাছেই পাবনা বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কম টাকায় এখানে খেতে আসে। অনেকে তাকে বলেছেন, খাবারগুলো ‘মায়ের হাতের রান্নার মতো লাগে’। এটাতেই তিনি আনন্দ পান। একবার কয়েকটি শিশু চাঁদা তুলে একটি করে লুচি খেতে এলে তিনি পর্যাপ্ত লুচি ও
মাংস তাদের প্লেটে তুলে দিলে 'অনেক টাকা বিল দিতে হবে’ ভেবে তারা ভয়
পেয়ে যায়। সোহানী হোসেন অভয় দিয়ে জানান, খাবারের কোনো টাকাই দিতে হবে না!
তার মা তাকে শিক্ষা দিয়েছেন, কখনো মন
খারাপ হলে বই
পড়তে। তাতে কাজ না হলে পশুপাখিকে সময় দেয়া আর
সবশেষ হলো স্রষ্টার কাছে সাহায্য চাওয়া।
তার মায়ের মতে, বিপদে কেবল আল্লাহ্-র কাছেই সাহায্য চাইতে হবে। কারণ মানুষকে বললে সে সাহায্য করার চেয়ে দুর্বলতার সুযোগ নেয় বেশি।
সোহানী হোসেন নিয়মিত নামাজ ও প্রার্থনা করেন। তার স্বামী ক্যান্সারে মারা যাওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১২ সালে তারও ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়ে।
তিনি একজন ক্যান্সারজয়ী নারী। এখনো প্রতিদিন নিয়ম করে সাঁতার কাটেন। ভোরে ওঠেন।
সন্ধ্যার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে নেন।
স্বামীর মৃত্যুর পর পাঁচ মেয়ের ভবিষ্যত ও ব্যবসার কর্মীদের মুখের দিকে তাকিয়ে হাল ধরেন ইউনিভার্সাল গ্রুপের। অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তিনি। করোনার সময়ে ইউনিভার্সাল ফুডের কার্যক্রম সাময়িক ভাবে বন্ধ করতে বাধ্য হন তিনি। জীবনে এসেছে একের পর এক বিপর্যয়।
ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের উদ্যোক্তা সোহানী হোসেন
সোহানী হোসেন জানান, অনেক বাধা, অপপ্রচার, চ্যালেঞ্জ নিয়ে তাকে চলতে হয়েছে। তার কাছে জীবন মানে যুদ্ধ। জীবন যেন তার লেখা গানের মতোই ‘কাঁটার সাথে সন্ধি’ করে এগিয়ে চলেছে।
সম্পাদক, বিপরীত স্রোত। সাংবাদিক ও গবেষক। অ্যাসোসিয়েট ফেলো, রয়াল হিস্টোরিকাল সোসাইটি।
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত
বাতিলযোগ্য সাইবার নিরাপত্তা আই.. বিস্তারিত
বাংলাদেশ তখনো বিশ্ব ক্রিকেট অঙ.. বিস্তারিত
ব্রেদিং আউট বার্ডেন নামে কর্ম.. বিস্তারিত