বিজয় মজুমদার
নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশকে আবার নতুন করে স্বাধীন করেছে। যখন অন্যেরা সেই স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপন করছিল আর ঠিক তখনই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি থানা, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুলিশ, যাদের বেশীর ভাগই কর্মচারী। জনমানসে যে তীব্র ক্ষোভ, সেই আগুনে নিহত হয়েছে তারা।
পুলিশ রাষ্ট্রের একটা প্রতিষ্ঠান। যার মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখা। পুলিশ আসলে মানবিক হবে না দানবিক রূপ ধারণ করবে সেটার পুরো দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কল্যাণকামী রাষ্ট্রে পুলিশের কাজ নাগরিক সেবা প্রদান, যেটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেরও প্রথম শর্ত। অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুলিশের মূল ভূমিকা বিরোধী দল দমন। বিরোধী দল ও ভিন্নমত দমনে, রাষ্ট্র পুলিশকে যতটা ছাড় দেওয়া যায় তার চেয়ে বেশী ছাড় দিয়ে থাকে। ফলে পুলিশ নিজের পেশাদারিত্ব হারিয়ে ফেলে। পরিণত হয় খুনি এক বাহিনীতে।
বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতায় যে বাহিনীটি স্বাধীনতার স্ফুলিঙ্গ প্রজ্বলিত করেছিল, সেটা এই পুলিশ বাহিনী। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে আগুনের লেলিহান শিখায় ছাই হয়ে গিয়েছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন। কামানের সাথে বন্দুকের এক অসম লড়াই পরিসমাপ্ত হয়েছিল মুক্তিকামী পুলিশ বাহিনীর লাশের নীচে। কিন্তু সে স্ফুলিঙ্গ কোনদিন দমেনি। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর আবার সেটা স্বাধীনতার সূর্য হয়ে উদিত হয়েছিল।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, এই পুলিশ বাহিনী, যাদের জনগণকে নিরাপত্তা প্রদান করার কথা, তারাই দ্বিতীয় স্বাধীনতায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে ও ভুগছে। আর সেটা এতটাই যে পুলিশের পোশাক পরা তো দুরে থাক, জীবনের নিরাপত্তায় কাজে যোগদান করার মত পরিস্থিতি ছিল না তাদের । ছাত্র জনতার এই আন্দোলনে পুলিশ বাহিনীর আত্মবিশ্বাসে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে সেটা সারতে অনেক বছর লেগে যাবে।
পুলিশী রাষ্ট্রের দায়ভার কতটুকু পুলিশের
বাংলাদেশ পুলিশের যাত্রা শুরু ব্রিটিশ শাসকদের হাতে। তারা পুলিশ বাহিনীকে একটাই উদ্দেশ্যে গড়ে তুলেছিল, সেটা ছিল ব্রিটিশ শাসকদের শাসনে সহায়তা করা। ব্রিটিশ আমলে যে রাজকর্মচারীটির দাপট সবচেয়ে দৃশ্যমান হত সেটি হলো পুলিশের দারোগা। দারোগার দাপটে বাঘে মহিষে এক ঘাটে জল খায়, কিংবা বাঘে ছুলে ১৮ ঘা, আর পুলিশে ছুলে ৩৬, এই প্রবাদগুলোর জন্ম ব্রিটিশ আমলেই। শাসকদের শাসনে সহায়তার জন্য যে ভাবে পুলিশকে ব্রিটিশ সরকার গড়ে তুলেছিল, পাকিস্তান আমল পার হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার পরেও পুলিশকে ঠিক সেই একই ব্যবহার করা হচ্ছে।
১৯৯০ এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর বাংলাদেশে যারা ক্ষমতায় এসেছিলেন তাদের সামনে সুযোগ ছিল বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে সংস্কার করার। তারা এই বাহিনীকে সেবামূলক বাহিনীতে পরিণত করবে নাকি বিরোধী দল দমনে ব্যবহার করবে সেটি বেছে নেওয়ার। বলাই বাহুল্য গণতান্ত্রিক দল হয়েও তারা দ্বিতীয় পন্থা বেছে নেয়।
বাংলাদেশের ক্ষমতার পালা বদলে দুটি দল দুটি জোটে পরিণত হয়েছে। একটা পর্যায় পর্যন্ত পালাক্রমে ক্ষমতায় আসলেও উভয় দল ও জোট পুলিশ বাহিনীকে ক্রমশ আরো নীচে নামিয়েছে। বিরোধী দল ও ভিন্নমত দমনে পুলিশ বাহিনীকে তারা যতটা সম্ভব বাজে ভাবে ব্যবহার করা যায় ততটাই বাজে ভাবে ব্যবহার করেছে। বেদনাদায়ক বাস্তবতা হচ্ছে উভয় দল বা জোট যখন বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে তখন সেই পুলিশ বাহিনীর নির্মমতার শিকার তারাই হয়েছেন সবার আগে ।
পুলিশের সংস্কার দরকার সবার আগে
বর্তমান যারা ক্ষমতায় এসেছেন, সেই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন সেটি এখনো স্পষ্ট হয়নি। তবে তারা রাষ্ট্র সংস্কার এর দাবীতে আন্দোলন করেছেন এবং এই প্রেক্ষাপটে তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে ভূমিকা রেখেছেন ও সরকারে যোগ দিয়েছেন। পুলিশের নির্মমতার আঁচ তাদের চেয়ে ভালো আর কেউ টের পায়নি। তারা এই সংস্কারে হাত দিতে পারবে কিনা জানি না, কিন্তু এখনই সময় পুলিশ বাহিনীকে মানবিক বাহিনীতে পরিণত করার। আর এটা দিয়ে শুরু হতে পারে রাষ্ট্র সংস্কার এর প্রথম ধাপ।
এই আন্দোলনে পুলিশের প্রতি মানুষের ঘৃণার তীব্র প্রকাশ একটি ভাইরাল ভিডিওতে ধরা পড়েছে। যে ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে একটা ছোট্ট শিশু দায়িত্বরত একদল পুলিশের দিকে বারবার ছুটে যাচ্ছে। তাদের গায়ে আঘাত করছে। আর শিশুটির অভিভাবক বার বার তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। এখানে কেবল এই একটি ঘটনাই ঘটেনি, আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল। যে দুজন পুলিশকে সে কোমল হাত দিয়ে আঘাত করছিল, সে দুজন পুলিশ তাকে আদর দিয়ে সেই ঘৃণা ফিরিয়ে দিয়েছিল।
তারা দুজন কারা?
তারা দুজন কোন দলীয় পুলিশ ছিলেন না।
ছিলেন পেশাদার পুলিশ।
যে পেশাদারিত্ব এ-দুজন দেখিয়েছেন সেটা তাদের কাজের প্রতি ভালোবাসা থেকে। আর এরজন্য দরকার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা।
কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকলেই কেবল পুলিশের কাজে পেশাদারিত্বের প্রতিফলন ঘটবে, আর কোন কিছুতেই নয়। এটা কেবল পুলিশের জন্য নয়, রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
লেখক পরিচিতি: কলামিস্ট