বিজয় মজুমদার
“বাদশা আলমগীর
কুমারে তাহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।“
এটি কবি কাজী কাদের নেওয়াজ এর বিখ্যাত কবিতা। বর্তমান সময়ে যা সবচেয়ে আলোচিত। যে কবি এই শিক্ষকের মর্যাদা কবিতাটা লিখেছেন তিনি নিজেই ছিলেন একজন শিক্ষক। তাঁর জীবন সম্বন্ধে জানার আগে একটা পাড়া সম্বন্ধে জেনে নেই।
পাড়ার নাম ছিল ফুটানিপাড়া। নামটা যেই শুনতো সেই হাসতো। আর জিজ্ঞেস করতো, “এ রকম নামের কারণ কী?”
পাড়ার লোকেরা উত্তর দিত, একবার এই এলাকার লোকেরা দিনাজপুরের মহারাজাকে খাজনা দিতে অস্বীকার করে। তখন রাজা বলেন, এই এলাকার লোকদের তো অনেক ফুটানী! সেই থেকে পাড়ার নাম হয়ে গিয়েছিল ফুটানীপাড়া।
এই পড়ার ঠিক সামনে লিওন মুসলিম হোস্টেল। যারা দূর দূরান্ত থেকে দিনাজপুর জিলা স্কুলে পড়তে আসতো তাঁদের আশ্রয়স্থল এই হোস্টেল। সেই হোস্টেলে এক মাস্টারও মাঝে মাঝে থাকতেন।
পাড়ার প্রবীণরা অনেক সময় রাতে বাড়ি ফেরার পথে আবিষ্কার করতেন হ্যারিকেন হাতে এক ব্যক্তিকে, যিনি হ্যারিকেন হাতে হোস্টেল পাহারা দিচ্ছেন। অন্ধকারে আলো নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষটি আর কেউ নন, সেই স্কুলের হেডমাস্টার কবি কাজী কাদের নেওয়াজ।
শিক্ষক কাজী কাদের নেওয়াজ বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর যে কবিতার মাধ্যমে সেটা হলো শিক্ষাগুরুর মর্যাদা, যা একসময় বাংলাদেশ টেক্সট বুক বোর্ডের পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ের পাঠ্য ছিল, মাঝখানে কিছুদিনের জন্য বাদ পড়ে যায়। আবার সেটি অন্তর্ভুক্ত হয়।
এই কবিতায় কবি মুঘল বাদশাহ আলমগীর ওরফে আওরঙ্গজেবের মুখ দিয়ে স্বীকৃতি দিয়েছেন শিক্ষকের মর্যাদা সবার উপরে।
ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকার পতনের পর শিক্ষকদের পদত্যাগ-এর প্রেক্ষাপটে এই কবিতাটি নেট দুনিয়া বিশেষ করে ফেসবুকে ভাইরাল আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।
শিক্ষক হয়ে যিনি নিজে শিক্ষককে সবার চেয়ে সম্মানিত করেছেন সেই কবি কাজী কাদের নেওয়াজ শিক্ষককে হিসেবে কেমন ছিলেন?
কবি কাজী কাদের নেওয়াজের গ্রামের বাড়ী মাগুরা জেলার শ্রীপুরে। তবে তাঁর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায়। তিনি নিজে এক মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় দেশ বিভাগের পর ঢাকার নবকুমার স্কুলে যোগ দেন। এরপর সামান্য কিছুদিন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের হেডমাস্টারের দায়িত্ব পালন করে ১৯৫১ সালে দিনাজপুর জেলা স্কুলে যোগ দেন।
দিনাজপুর জিলা স্কুলের সাথে যেন স্যারের আত্মার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। স্যার এই স্কুল থেকে আর অন্য কোনো স্কুলে যান নি, এই স্কুল থেকেই তিনি ১৯৬৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
যে যুগে শিক্ষক মানে এক কঠিন ব্যক্তিত্ব শক্তি হাতে কঠিন
সব
শাস্তি
দিয়ে
পড়া
আদায়, সেই যুগেও তিনি অনেকটা নরমপন্থী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
স্কুলে তিনি যা পড়াতেন সেটা ছাত্ররা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতো । দিনাজপুরের অনেকে জানতেন তিনি চিরকুমার। তবে তিনি অসুখী বিবাহিত জীবনে নিঃসঙ্গ ছিলেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন, তাই হয়তো প্রতিটি ছাত্রকে তিনি নিজের সন্তানের মত দেখতেন।
সে সময় কাজী কাদের নেওয়াজকে নিয়ে একটা প্রবাদ ছিল, তিনি গর্জান, কিন্তু বর্ষাণ না। মানে কেউ পড়া না পারলে, দুষ্টামি করলে স্যার হুঙ্কার দিতেন, “শাহাবুদ্দিন।“
শাহাবুদ্দিন ছিলেন জিলা স্কুলের সবচেয়ে পুরনো পিয়ন। তাঁর কাজ ছিলো স্যারের লাঠি বহন করা।
সবাই জানতো স্যার লাঠির কথা বলবেন ঠিকই, কিন্তু লাঠি আসলে তিনি নিজেই বিষণ্ণ হয়ে যেতেন। এক অদ্ভুত উপায়ে তিনি ছাত্রদের কাছ থেকে পড়া আদায় করতেন। কেউ পড়া না পড়লে দেখতো যে স্যার মন খারাপ করে ফেলেছে।
স্যার যদি খুবই রেগে যেতেন, তখন শুধু লাঠি হাতে নিতেন। সেই লাঠি অনেক উপর থেকে এমন ভাবে আসতো যে সেটা হাতের উপর প্রচণ্ড জোরে আঘাত করবে, কিন্তু স্যার প্রচণ্ড জোরে তুলে খুবই আস্তে সেই লাঠি দিয়ে বাড়ি দিতেন।
কেউ যদি কোন ভুল কিংবা অপরাধ করতো, স্যার তাঁকে নিজের কামরায় ডেকে নিয়ে যেতেন। সবাই ভাবতো ভালো উত্তম মাধ্যম হবে। কিন্তু স্যার আগে জিজ্ঞেস করতেন, কেন সে এই কাজটি করেছে? তারপর সেই কাজটি করতে মানা করতেন।
মা-এর প্রতি স্যারের খুবই দুর্বলতা ছিল। মা সম্বন্ধে কোন কিছু খারাপ ঘটতে শুনলেই তিনি কাতর হয়ে যেতেন। সেই সুযোগে অনেক দুষ্টু ছেলে গিয়ে স্যারকে বলত, “স্যার আমার মা খুব অসুস্থ ছিল সেই কারণে কালকে আসতে পারিনি। কিংবা যদি কেউ পড়া না পাড়তো তাহলে স্যারকে অজুহাত দিতো মা খুব অসুস্থ ছিল, তাঁর সেবা করতে গিয়ে স্যার এবার আর পড়া করা হয়নি। ব্যাস তাহলে সব শাস্তি মাফ।
মা-এর প্রতি ভালোবাসায় কবি কাজী কাদের নেওয়াজ মা নামে যে কবিতাটি লিখেছিলেন সেটাকে অনেকে তাঁর অন্যতম সেরা কবিতা মনে করে।
স্যারকে খুশি করার সেরা উপায় ছিলো স্যারের কবিতা আবৃত্তি করা। তার সময়ে জেলা স্কুলে শুধু ভালো রেজাল্ট করার জন্য নয়, সেই সাথে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়।
কাজী কাদের নেওয়াজ নিজে নাটক লিখতেন, আর স্কুলে ছাত্ররা তাতে অভিনয় করতো। স্যার শুধু নিজে নন, অন্য শিক্ষকদেরও লেখায় উৎসাহ দিতেন। তাজমিলুর রহমান স্যার, শ্রী গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য (পণ্ডিত স্যার) এরা সবাই সাহিত্যিক ছিলেন। স্কুলের ছেলেরা এই সকল স্যারদের লেখা নাটকেও অভিনয় করতো।
সাহিত্য ছাড়াও খেলাধুলাতেও স্যার দারুণ উৎসাহী ছিলেন। সে সময় দিনাজপুর জিলা স্কুলের ফুটবল, ক্রিকেট ও হকি টিম ছিল, স্যার অবসরে যাওয়ার আগে দিনাজপুর জিলা স্কুলের বাস্কেটবল টিম তৈরি হয়। এমন কী স্রেফ ভালো রেজাল্টের জন্য পরিচিত দিনাজপুর জিলা স্কুল ১৯৬৪ সালে দিনাজপুর জেলা আন্ত স্কুল হকিতে চ্যাম্পিয়ন হয়।
কাজী কাদের নেওয়াজ শিশু সাহিত্যিক হিসেবে ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। এর মূল্য ছিল ২০০০ টাকা।
সে সময় কবি কাজী কাদের নেওয়াজকে ঘিরে সমগ্র দিনাজপুর শহরে এক সাহিত্য চর্চার আসর তৈরি হয়েছিল। দিনাজপুর শহরে তিনি এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে তাঁর বিদায়ে কেবল একটা স্কুল নয়, পুরো একটা শহর অনেক দিনের জন্য বিষণ্ণ হয়ে গিয়েছিল।
বিশেষ দ্রষ্টব্য- এই লেখা অনেকের স্মৃতিচারণ। কাজেই তথ্যের কিছুটা হেরফের হতে পারে। আর কবি কাজী কাদের নেওয়াজের বিখ্যাত যে কবিতা এখন ভাইরাল, সেটার শিরোনাম কিন্তু “শিক্ষকের মর্যাদা” বা “শিক্ষাগুরুর মর্যাদা” ছিল না, সেটার নাম ছিল “ওস্তাদের কদর।“
লেখক পরিচিতি: কলামিস্ট
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত
বাতিলযোগ্য সাইবার নিরাপত্তা আই.. বিস্তারিত
বাংলাদেশ তখনো বিশ্ব ক্রিকেট অঙ.. বিস্তারিত
ব্রেদিং আউট বার্ডেন নামে কর্ম.. বিস্তারিত