English
ঢাকা, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

প্রকাশঃ ২০২৪-১০-১০ ০৭:০১:১৫
আপডেটঃ ২০২৪-১০-১৮ ১৫:১৭:৩৭


সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি

সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি


"বাতিলযোগ্য সাইবার নিরাপত্তা আইন: জনগণের প্রত্যাশা" শিরোনামে ডিজিটালি রাইট, নাগরিক এবং বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর অফিস (ইউএনআরসি)-এর আয়োজনে গত ০৮ অক্টোবর, ২০২৪, সকাল ১০.৩০ থেকে দুপুর .৩০ পর্যন্ত, জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া (ভিআইপি রুম) হলে, নাগরিকদের অংশগ্রহণে একটি গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। নাগরিক সংগঠনসমূহের উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন দেশের বিভিন্ন জেলায় নিপীড়নমূলক সাইবার আইনসমূহের শিকার প্রতিবাদী ভুক্তভোগীগণ। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃস্থানীয় অধিকারকর্মী, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, লেখক, শিল্পী, শ্রমিক, এবং প্রচারমাধ্যমের সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

গোলটেবিলে বলা হয়, ‘তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার নিরাপত্তা আইনগুলোর প্রায় একই ধারায় ঘুরেফিরে হাজার হাজার মানুষের নামে মামলা হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে।সমালোচিত এই আইনটি বাতিলের দাবি উঠেছে। পাশাপাশি এসব আইন দ্বারা যারা হয়রানির শিকার হয়েছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ ন্যায়বিচারের দাবিও উঠেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক সিআর আবরার-এর সভাপতিত্বে পুরো আয়োজনের সঞ্চালনা করেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।  বক্তব্য রাখেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, মানবাধিকার কর্মী ও আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের কর্মকর্তা লিভিয়া কসোনজা, আর্টিকেল নাইনটিনের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম, ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী, ইন্টারনিউজ  নেটওয়ার্কের বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ শামীম আরা শিউলী,  রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোস্তফা হোসেইন,  শরৎ চৌধুরী,  ভুক্তভোগীদের মধ্যে দিদারুল ভূঁইয়া, খাদিজাতুল কোবরা, দিলীপ রায়, নুসরাত সোনিয়া,সাংবাদিক আবু তৈয়ব মুন্সী এবং আবদুল লতিফ ।

গোলটেবিল বৈঠকে একটি ধারণাপত্র তুলে ধরেন মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন। ধারণাপত্রটি এখানে প্রকাশ করা হলো:

 

ধারণাপত্র

কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে, ২০২৪ সালের জুলাই আগস্ট মাসের হত্যাযজ্ঞের মধ্যে সৃষ্ট গণঅভ্যুত্থানের ফলে বিগত ০৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ এবং দেশ ছাড়তে বাধ্য হন এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে, . ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। ২০২৪ সালের ৮ই আগস্ট, রাষ্ট্রপতির নিকট শপথ গ্রহণের মাধ্যমে . মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুইজন সমন্বয়ক যুক্ত করে নতুন এই সরকারে ২১ জন উপদেষ্টা আছেন। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা জনাব নাহিদ ইসলামের সঙ্গে একমত হয়ে বলতে চাই, নিরবিচ্ছিন ইন্টারনেটের ব্যবহারের নিশ্চয়তা নাগরিক মৌলিক অধিকার মানবাধিকার।

অন্যদিকে, ০৯ আগস্ট ২০২৪ তারিখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ক্ষমতা গ্রহণের পরে বলেছেন; ‘ক্ষমতা একটা গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে পড়লে অসুবিধা হয় না কিন্তু সরকার অগণতান্ত্রিক হলে তখন আইনের অপপ্রয়োগ হয়। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনের যে বিধানগুলো অপপ্রয়োগ করা হয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে বাতিল করা হবে পরবর্তীতে, অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বিগত ০৩ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে, রাজধানীতে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি নিয়ে সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধন বিষয়ক মতবিনিময় সভা করেন এবং সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, “সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল হবে। সেইসঙ্গে সাইবার সুরক্ষা দিতে নতুন আইন করা হবে। বিশেষ করে নারীদের সুরক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে কাজ করবে এটি। সাইবার নিরাপত্তা আইনের আওতায় হওয়া মামলাগুলো প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে, আমরা এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই কিন্তু একইসাথে বিগত সরকারের সময়কালের মত, আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং অভ্যন্তরীণ গণমাধ্যম কর্মীবৃন্দ, লেখক, গবেষক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, আইনজীবী, মানবাধিকার ডিজিটাল অধিকার কর্মীবৃন্দ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার এবং সাইবার পরিসরে অধিকার বাস্তবায়নের বাস্তবতা সুরক্ষা প্রদানের নীতি-নৈতিকতা কর্মকাণ্ড সবই নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনা করতে চাই। বিশেষ করে কেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনটি বাতিল করা প্রয়োজন এবং আগামীতে কেমন আইন-বিধি নীতিমালা প্রস্তুত করা প্রয়োজন সেই বিষয়েও নজর দিতে চাই। এক্ষেত্রে, আমরা এবং আমাদের মতামত অনেক বৃহৎ ভিন্ন অংশীজনের মাঝে ক্ষুদ্র, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।

 

সাইবার নিরাপত্তা আইনটি কেন বাতিলযোগ্য?

বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকার ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ তারিখে গণদাবীর প্রেক্ষাপটে নিপীড়নমূলক এবং নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ রহিত করেছিল। নাগরিকদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় এবং পর্যাপ্ত আলোচনা ব্যতীত, গণদাবী উপেক্ষা করে, বাতিলকৃত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রায় একই আদলে 'সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩' নামে নতুন আরেকটি গণবিরোধী আইন প্রণয়ন করেছিল এবং আইনটি নিপীড়নমূলক চর্চা বজায় রেখে তা এখনও কার্যকর রয়েছে। একইসাথে, বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল এম আমিন উদ্দিন নাগরিকদের জানিয়েছিলেন, বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে নতুন আইন প্রনয়ণ হলেও আগের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত পাঁচ বছরে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেই মামলাগুলো চলবে। মুক্ত গণমাধ্যম ডিজিটাল অধিকার কর্মী হিসাবে আমরা অকম্পিত দৃঢ়কণ্ঠে বলতে চাই, বর্তমান সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলযোগ্য, কোনভাবেই সংশোধনযোগ্য নয়; কেননা সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া ছিল অবৈধ এবং বেআইনি।

১। 'সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ আইন প্রনয়ণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে নাগরিকদের অংশগ্রহণ এবং দায়বদ্ধতা ছিল শূন্য থেকে মহাশূন্যময়; আইন-নীতিমালাসমূহ সংশোধন পর্যালোচনার প্রণয়নে এবং সময় সমতার সুযোগ ছিল অপর্যাপ্ত এবং অপরিচ্ছন্ন, যার নেতিবাচক ফল সরাসরিভাবে মানবাধিকার গণমাধ্যমের সংগঠনসমূহ এবং কর্মীবৃন্দ ভোগ করেছেন, এখনও করছেন এবং সামনের দিনগুলোতে আরও করবেন বলে আমরা মনে করি৷

২। বলবৎযোগ্য সাইবার নিরাপত্তা আইনটি জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়েছে ; প্রায় সব ধারার সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা অপ্রতুলতা রয়েছে; আইনে অনেক অপরাধের সংকীর্ণ সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে এবং অপরাধের অভিপ্রায় সম্পর্কে পর্যাপ্ত নজর রাখা হয়নি এবং আন্তর্জাতিক সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত চুক্তির বিকশিত মানগুলোর সঙ্গে অসামঞ্জস্য।

৩। মুক্ত গণমাধ্যম ডিজিটাল অধিকার কর্মীবৃন্দ হিসাবে আমরা বলিষ্ঠভাবে মনে করি, পুরাতন চারটি প্রশাসনিক সংগঠনসমূহের সাইবার আইনে গঠন (জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কাউন্সিল, জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি; জাতীয় কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে কম্পিউটার ইন্সিডেন্ট রেসপন্স টিম এবং ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব) প্রক্রিয়ায় স্বাধীন নিরপেক্ষ বিচারবিভাগীয় বা সংস্থা কর্তৃক তত্ত্বাবধানের সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিতি।

৪। একই বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে একাধিক মামলা করার প্রবণতা।

৫। বিচার-পূর্ব কারাবাসকে শাস্তি হিসাবে গণ্য করার কোনো সুযোগ নেই, তাই বিচার-পূর্ব কারাবাসের সময় সম্পর্কে বিভিন্ন দেশে সুনির্দিষ্ট নীতি রয়েছে। যদি তদন্তকারী সংস্থা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে জামিন পাওয়া অভিযুক্তের অধিকার হিসেবে বিবেচিত হবে। এছাড়াও, আমাদের কোন অপরাধের কি সাজা হবে তা নিয়েও কোন আইন বা নীতিমালা নেই; ফলস্বরূপ, এই আইনে অসম এবং অস্পষ্টভাবে শাস্তির বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সাম্প্রতিক আইনগুলোর পরস্পর বিরোধী অবস্থান আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে আরও জটিল করে তুলেছে এবং প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের হল এসব পরস্পর বিরোধী আইন নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করছে।

উদাহরণস্বরূপ- যখন "জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা) আইন, ২০১১ মানুষকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে উত্সাহিত করে, তখন সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২১, ২৫, ২৯ ৩১ ধারা জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশকে নিরুৎসাহিত করে৷ ধারা ২৫ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মিথ্যা এবং আপত্তিকর তথ্য প্রকাশকে অপরাধীকরণ করে। জনপ্রতিনিধি সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য কোভিড-১৯ এর প্রথম ধাপে অনেক সাংবাদিক অধিকারকর্মীদেরকে বাতিলকৃত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। বিচারক এবং তদন্তকারী কর্তৃপক্ষকে বাতিলকৃত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার তদন্ত বিচার করার যথাযত প্রশিক্ষণ ছাড়াই আইনের প্রয়োগ করতে দেয়ার কারণে নাগরিকদের বিচারিক হয়রানি বেড়েছে।

৬। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনে অপরাধের বিপরীতে ধারাসমূহে যে শাস্তির বিধান করা হয়েছে তার অধিকাংশই মাত্রাতিরিক্ত, অসম, অনুপাতহীন এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন, ধারা ২৯ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মানহানিকর তথ্য প্রকাশকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করে, এবং একই অপরাধ দ্বিতীয়বার হলে বা পুনরাবৃত্তি ঘটলে শাস্তির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। অথচ, বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় মানহানি করাকে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়ন করেছে এবং ধারা ৫০০ মানহানির জন্য শাস্তির বিষয়ে উল্লেখ আছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মানহানির জন্য উপরোক্ত আইনের সংজ্ঞা ব্যবহার করা হলেও ভিন্ন শাস্তির বিধান করা হয়েছে যা সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক। একই অপরাধের জন্য একজন অভিযুক্তকে উচ্চতর সাজা দেওয়া যাবে না। যেহেতু ধারা ২৯, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ এর বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক তাই সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে এটি অকার্যকর হয়ে যায়। তাই অবিলম্বে এই অবৈধ, বেআইনি এবং বাতিলযোগ্য ধারা বাতিল করতে হবে।

৭। সাইবার ট্রাইব্যুনালের আদেশ বা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি। বিশেষ আইনের পরিপ্রেক্ষিতে যেহেতু তামাদি আইনের প্রয়োগ হয় না, তাই আপীলের সময় উল্লেখ না থাকলে ট্রাইব্যুনালের যে কোন আদেশ কিংবা রায়ের বিরুদ্ধে আপীল দায়ের করার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয়। তাছাড়া, আইনে সাইবার আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করার কথা থাকলেও অদ্যাবধি তা গঠন করা হয়নি। আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন না করে উচ্চ আদালতের উপর প্রশিক্ষণ ছাড়াই বাড়তি দায় চাপানো হয়েছে।

 

৮। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক আইনের অপব্যবহার হলে বিচারিক জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা সাইবার নিরাপত্তা আইনের ধারা ৩৯ অনুযায়ী তদন্ত শেষ করতে ৯০ দিন সময় পান এবং উচ্চতর কর্তৃপক্ষ তদন্ত সম্পন্ন করতে আরও ১৫ দিন সময় মঞ্জুর করতে পারেন। এই ১০৫ দিন সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তদন্তের সময় বাড়ানোর ক্ষমতা আইনে সাইবার ট্রাইব্যুনালকে দেওয়া হয়েছে। উপরোক্ত ধারার গুরুতর লঙ্ঘন হচ্ছে এবং হয়েছে। যেহেতু আইনে অভিযোগ প্রমাণ হলে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবং কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া জামিন পাওয়া যায় না, তাই, আইনের কোনও নির্দিষ্ট বিধান যদি তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ এবং বিচারকবৃন্দ প্রতিপালন না করে থাকেন, তাহলে সেক্ষেত্রেও আইনের কঠোর প্রয়োগ শাস্তির বিধান থাকা যুক্তিযুক্ত ছিল। এই আইনি অসমতা সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক।

১০। সাইবার নিরাপত্তা আইনে মিথ্যা, প্রতারণা হয়রানিমূলক কোন মামলা করা হলে প্রতিকারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু যাঁরা এখন পর্যন্ত মিথ্যা, প্রতারণা হয়রানিমূলক মামলার বা সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ডে ক্ষতির শিকার হয়েছিলেন এবং হচ্ছেন, তাঁদের সামাজিক, রাজনৈতিক আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদানের আইনি ব্যবস্থা না করা এবং নৈতিক হ্যাকিংকে অপরাধিকীকরণ করা নিন্দনীয় এবং গর্হিত।

১১। গ্রেপ্তারী পরোয়না ছাড়া আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে ক্ষমতা অর্পণ বা কোনো আদালতের আদেশ ব্যতীত সন্দেহবশে গ্রেপ্তার, মালামাল জব্দ এবং অপরাধ হবার সম্ভাব্যতায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে এক প্রকার অবাধ বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

১২। শিশু আদালতের সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই আগামীতে সাইবার পরিসরে অভিযুক্ত শিশুদেরবিচারএবংশাস্তিপ্রদান করবার আইনগত ভিত্তি তৈরী করেছে, যা নাগরিকদের চিন্তা, বিবেক মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার, আইনে সমান আশ্রয় লাভের অধিকার এবং শিশুদের জন্য অধিকতর সুরক্ষা প্রদানের মতো মৌলিক মানবাধিকারগুলোকে ক্ষুণ্ন করেছে এবং করছে। সাইবার নিরাপত্তা আইনে শিশু-কিশোরদের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে কোন বিধান রাখা হয়নি, ফলে দিনাজপুরের কিশোরী দীপ্তি রানি দাশকে দেড় বছর মহিলা শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে কাটাতে হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে ২০১৩ সালের নতুন করে শিশু আইন প্রণয়ন করেছে এবং সেই আইনের বিধান মতে কোন অভিযুক্ত শিশুকে শাস্তি প্রদান করবার কোন প্রকার আইনগত সুযোগ নেই। অথচ সাইবার নিরাপত্তা আইনের নামে ব্যাপকভাবে শিশুদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অধিকার ভঙ্গ করে গ্রেফতার করে বিচার করা হচ্ছে। সাইবার নিরাপত্তা আইন স্পষ্টত জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের সাথে সাংঘর্ষিক।


জনগণের প্রত্যাশা (আংশিক যেহেতু ক্ষুদ্র?) তবে কেমনঃ

আমাদের আলাপ স্পষ্ট, সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধনযোগ্য নয়, সম্পূর্ণ বাতিলযোগ্যঃ

. বাংলাদেশে সাইবার 'নিরাপত্তা' আইন নামে আইনের প্রয়োজন নাই তবে সাইবার সুরক্ষা আইন নামের নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তা আছে, বিগত স্বৈরাচার সরকার যে নিপীড়নমূলক আইন নাগরিকদের বিরুদ্ধে করেছে তা ব্যবহার বন্ধ করে নাগরিকবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনা করে নতুন সাইবার সুরক্ষা আইন করতে উদ্যোগী হতে হবে। সুতরাং, সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল হবার ঘোষণা দিতে হবে এবং নতুন সাইবার সুরক্ষা আইন প্রণয়নে আলাপ আলোচনা শুরু করতে হবে।

. নাগরিকদের অংশগ্রহণে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে যে সকল সাইবার সংক্রান্ত আইনসমূহ মামলার মধ্যে মৌলিক মানবাধিকারের বিরুদ্ধে আঘাত করেছে সেই সকল মামলাসমূহ অচিরে বাতিল করতে হবে; অবশ্যই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করবে।

. গণঅধিকার হরণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে, সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকার অনেকগুলো নতুন আইন-নীতিমালা খসড়া (যেমন: ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২৪ (খসড়া) ওভার দ্যা টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিসেবা প্রদান এবং পরিচালনা নীতিমালা-২০২১) এবং পুরাতন আইনের (যেমন: বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০১) সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল৷ এই আইনসমূহ প্রনয়ণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে নাগরিকদের অংশগ্রহণ এবং দায়বদ্ধতা ছিল শূন্য থেকে মহাশূন্যময়; প্রস্তাবিত আইন-নীতিমালাসমূহ সংশোধন প্রণয়নে এবং পর্যালোচনার সময় সমতার সুযোগ ছিল অপর্যাপ্ত এবং অপরিছন্ন, যার নেতিবাচক ফল সরাসরিভাবে মানবাধিকার গণমাধ্যমের সংগঠনসমূহ এবং কর্মীবৃন্দ ভোগ করেছেন, এখনও করছেন এবং সামনের দিনগুলোতে আরও করবেন বলে আমরা মনে করি৷ কারণ অবৈধ এবং নিপীড়নমূলক আইনসমূহ কার্যত রাষ্ট্র, শাসকশ্রেণি, ক্ষমতাধর, বিত্তবানদের স্বার্থই রক্ষা করে৷

বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন

 


ক্যাটেগরিঃ রাজনীতি,
সাবক্যাটেগরিঃ দেশ,