ড. বিজন কুমার শীল
গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগীয় প্রধান, অধ্যাপক ড. বিজন কুমার শীল (৫৯) দেশে এবং বিদেশে একজন বিজ্ঞানী ও গবেষক হিসেবে পরিচিত। প্রচারবিমুখ এই ভাইরোলজিস্ট নব্বইয়ের দশকে ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের কালো ছাগলের সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন। যা বর্তমানে দেশ জুড়ে ছাগল উৎপাদনের ব্যাপকতার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০০২ সালে ডেঙ্গু শনাক্তকারী কুইক টেস্ট পদ্ধতি তিনি আবিষ্কার করেন। একজন সার্বক্ষণিক গবেষক ড. বিজন কুমার শীল ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস শনাক্তের কিট আবিষ্কার করে পৃথিবী জুড়ে আলোচনায় আসেন। সিঙ্গাপুরে তার নামে এটি প্যাটেন্ট করা হয়। এই কাজে সিঙ্গাপুর সরকার তাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দান করে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে সার্স প্রতিরোধে তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হন। কোভিড-১৯ সংক্রমণের শুরু থেকেই তিনি গবেষণায় নেমে পড়েন। করোনা ভাইরাস মানবদেহে কী ক্ষতি করতে পারে এবং এর থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে তিনি কাজ শুরু করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর উৎসাহ ও সহযোগিতায়। যার ফল হিসেবে ১৭ মার্চ ২০২০ তিনি ও তার গবেষণা টিম বাংলাদেশে করোনা শনাক্তের র্যাপিড টেস্ট কিট ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট’ আবিষ্কারের ঘোষণা দেন পৃথিবীর অনেক দেশ এ নিয়ে কিছু করার আগেই। সুস্থ হয়ে ওঠা করোনা রোগীর প্লাজমা দিয়ে করোনা চিকিৎসায় ‘হাইপার ইমিউন সিরাম থেরাপি’-র বিষয়টি তিনি প্রকাশ করেন ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, আর আমেরিকা এর প্রথম প্রয়োগ শুরু করে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
ড. বিজন কুমার শীল জন্মেছেন ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ সালে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার কালিকাপুর গ্রামে এক কৃষক পরিবারে। বাবা রসিক চন্দ্র শীল এবং মা কিরণময়ী শীলের ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি পঞ্চম। বনপাড়া সেন্ট জোসেফ হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করে ভর্তি হন ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভেটেরিনারি সায়েন্স বিভাগ থেকে অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। মাস্টার্স করেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে। কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে নিয়ে বৃটেনের ইউনিভার্সিটি অফ সারে-তে পড়াশোনা করতে যান। সেখানে তার পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর উপায় নিয়ে ‘ডেভেলপমেন্ট অফ মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিজ’। ইমিউনোলজির ওপর পোস্ট ডক্টরাল পড়াশোনা করেন জাপানের কিটাসাটো ইউনিভার্সিটিতে। তার নামে চোদ্দটি আবিষ্কারের প্যাটেন্ট রয়েছে। গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে অনেক জার্নালে। গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন বিশ্বের বহু দেশে। শিক্ষা জীবন থেকেই নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বেড়ে ওঠা ড. বিজন কুমার শীল কর্মজীবনেও নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। কিন্তু সব সময়ই তিনি কাজের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন এবং দেশের প্রতি দায়িত্ব পালনে কখনোই অবহেলা করেন নি। যার ফলে দেশের বাইরে অনেক সুযোগ সুবিধা স্বীকৃতি ফেলে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং বর্তমানে শিক্ষকতার পাশাপাশি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গবেষণাগারেই তার বড় সময় কাটে। স্ত্রী অপর্ণা রায় একজন প্রাণী চিকিৎসক। তাদের এক ছেলে অর্ণব কুমার বৃটেনের ম্যানচেস্টার ও এক মেয়ে অরুন্ধতী সিঙ্গাপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন। বর্তমান করোনা পরিস্থিতি ও ভবিষ্যতে করণীয় নিয়ে ড. বিজন কুমার শীলের সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলেছেন বিপরীত স্রোত সম্পাদক মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান।
৭ মার্চ ২০২০
গণ
বিশ্ববিদ্যালয়ে
‘সুপ
টু
সিক
বেড’নামে
এক
সেমিনারে
ড.
বিজন
কুমার
শীল
করোনা
ভাইরাসের
গতি
প্রকৃতি
ও
বাংলাদেশে
এর
সম্ভাব্য
প্রভাব
নিয়ে
আলোচনা
করেন
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান:
কোভিড-১৯ বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার শুরুর সময় থেকেই এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন ও সতর্ক করার চেষ্টা করেন আপনি। ৭ মার্চ ২০২০ গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সুপ টু সিক বেড’ নামে এক সেমিনারে জানিয়েছিলেন, দুটি কারণে করোনা ভাইরাস বাংলাদেশের মানুষের ওপর পশ্চিমি বিশ্বের মতো ক্ষতি করতে পারবে না। বিষয়টি যদি একটু বলতেন।
ড. বিজন কুমার শীল: ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস নিয়ে আমি কাজ করি সিঙ্গাপুরে। সার্সের সঙ্গে বর্তমান করোনা ভাইরাসের শতকরা আশি ভাগেরও বেশি মিল রয়েছে। সে সময় গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, বাংলাদেশ ও এই অঞ্চলের মানুষের দেহে এসিই-টু এনজাইমের পরিমাণ কম থাকায় ভাইরাসটি কম আক্রমণ করছে বা তারা আক্রান্ত হলেও কম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু চায়নিজ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এসিই-টু এনজাইমের পরিমাণ বেশি থাকায় তারা সহজেই আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসের কারণে ইমিউন সিস্টেম সক্রিয়। এই দুটো বিষয় বাংলাদেশের মানুষকে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি সুরক্ষিত রেখেছে। ইটালির মানুষের এসিই-টু এনজাইমের পরিমাণ তুলনামূলক কম থাকলেও তাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল থাকায় তারা বেশি অক্রান্ত হয়েছেন।
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান:
বাংলাদেশের মানুষের ইমিউন সিস্টেম কীভাবে আমাদের রক্ষা করছে?
ড. বিজন কুমার শীল: অনেকে বলেছিলেন বাংলাদেশে মৃত্যু এতো বেশি হবে যে পথে ঘাটে লাশ পড়ে থাকবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি। এদেশের মানুষের ইমিউন সিস্টেম এই প্রতিরক্ষা বলয় তৈরি করেছে। মানব দেহের প্রতিরক্ষার কাজ করে ইমিউন সিস্টেম। অনেকটা সীমান্তে বাইরের শত্রু মোকাবেলায় বর্ডার গার্ডের মতো। বাংলাদেশের আবহাওয়া, খাবার, নানা রোগ বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে এদেশের মানুষের ইমিউন সিস্টেমকে সব সময়ই সক্রিয় থাকতে হয়। ভাইরাস বা অন্যান্য বাইরের আক্রমণ থেকে সব সময়ই দেহকে রক্ষা করতে তা সজাগ থাকে। আমি ল্যাবরেটরিতে কারো কারো দেহে ভাইরাসের আধিক্য দেখে বিস্মিত হয়ে পড়ি! নানা রকমের ভাইরাসের সঙ্গেই এদেশের মানুষ বসবাস করে। ফলে নতুন কোনো ভাইরাস যদি শরীরে ঢুকতে চায় তখনও এই সিস্টেম তাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। ইটালি বা পশ্চিমি দেশের মানুষের ইমিউন সিস্টেম নিষ্ক্রিয় থাকে। কারণ তাদের সাধারণ জীবনে এই চ্যালেঞ্জগুলো কম। তারা অনেক রোগের প্রতিষেধক তৈরি করেছে। আমাদের মতো হাজারো ভাইরাসের মুখোমুখি তাদের হতে হয় না। তাদের জীবনধারা এবং খাদ্যাভ্যাস ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতি করে। ফলে নতুন কোনো ভাইরাস যখন আক্রমণ করে তখন তাদের দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা কাজ করে না। সহজেই তারা আক্রান্ত হয়ে পড়েন।
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান: সার্স ভাইরাসটি পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে নি কিন্তু করোনা ভাইরাস কেন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লো?
ড. বিজন কুমার শীল: ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস যখন আক্রমণ করে তখন মানুষের যোগাযোগ এখনকার মতো এতো বেশি ছিল না। বিশেষ করে এখনকার বাজেট এয়ারলাইন্সের সাহায্যে কম খরচে মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে পারে। চায়নায় করোনা দেখা দেয়ার পর তারা অনেক সামাজিক প্রোগ্রামে উপস্থিত হয়েছেন স্বাস্থ্যবিধি না মেনে। ফলে তা ছড়াতে পেরেছে দ্রুত। সবচেয়ে বড় বিষয় সার্সের পর পৃথিবীর মানুষকে পরবর্তী ভাইরাস হামলার হাত থেকে রক্ষা করতে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন - ডাবলিউএইচও কোনো কার্যকর ভূমিকা নেয় নি। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করে নি। এখনো তারা একেক সময় একেক ধরনের বক্তব্য দিচ্ছে।
সার্স ভাইরাসটির গঠন সম্পর্কে আমরা পুরোপুরি জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু এবারের করোনা ভাইরাসের গতিবিধি আগের কোনো নিয়ম মানছে না। এর লক্ষণ বিভিন্ন রকম হচ্ছে। জ্বরের সাথে কারো প্রচন্ড ক্লান্তি লাগে। কারো গায়ে ব্যথা। কারো সারা গায়ে চুলকানি। কারো বা সামান্য মাথাব্যথা। কারো মুখে স্বাদ থাকছে না। কারো আবার পাতলা পায়খানা হচ্ছে। এর পেছনে ভাইরাসের অভিযোজন বা অ্যাডাপ্ট করার ক্ষমতা কাজ করছে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, কোনো দেহে যদি এক লাখ ভাইরাস ঢোকে আর আরেকটি দেহে যদি দশ হাজার ভাইরাস ঢোকে তবে স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হবে। এর বাইরে কিডনি বা লিভারের সমস্যা, ডায়াবেটিসসহ এ ধরনের রোগ যাদের আগে থেকেই আছে তারা আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। তবে কেউ আক্রান্ত হলেই মারা যাবেন তা ঠিক নয়।
করোনা শনাক্তকারী ‘জিআর
কোভিড-১৯
ডট
ব্লট’
কিটের
পরিচিতি
তুলে
ধরছেন
ড.
বিজন
কুমার
শীল
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান:
অনেকে ভয় পাচ্ছেন একবার আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়ার পর আবার করোনা হয় কিনা?
ড. বিজন কুমার শীল: একবার কেউ করোনা থেকে মুক্ত হলে তার আর আক্রান্ত হওয়ার আশংকা নেই। সম্প্রতি একটি অনলাইন মিটিংয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তিনশ বিজ্ঞানীর উপস্থিতিতে একজন এই প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন। আমি বলেছি, আমরা বিজ্ঞানী, আমাদের এভাবে কথা বলা উচিত নয়। সাধারণ মানুষ তাহলে কার কাছে সান্ত্বনা পাবেন। ডাক্তাররা চিকিৎসা করছেন কিন্তু ভাইরাস সম্পর্কে মানুষ বিজ্ঞানীদের মতামত জানতে চান। আমাদের বিজ্ঞানসম্মত কথা বলতে হবে। কারো শরীর থেকে অ্যান্টিবডি কমে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে, তিনি আবার করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। একজন মানুষ করোনার আক্রান্ত হওয়ার পর দুটো পরিবর্তন ঘটে তার শরীরে।
এক. কিছু বায়োম্যাটার তৈরি হয়। যেটাকে অ্যান্টিবডি বলে যা পরবর্তীতে এই রোগ প্রতিরোধে কাজ করে।
দুই. আরো ভালো যে ঘটনাটি ঘটে তা হলো আমাদের দেহে মেমোরি সেল তৈরি হয়। আক্রান্ত হওয়ার চোদ্দ পনেরো দিনের মধ্যেই মেমোরি সেল তৈরি হয়ে যায়। এরপর যদি কখনো আপনি এই ভাইরাসের সামনে পড়েন, যা ইমিউন সিস্টেম শনাক্ত করে তবে এই মেমোরি সেলগুলো ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই অ্যান্টিবডি তৈরি করা শুরু করে দেয়। এই মেমোরি সেলগুলোর ওপর আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে। তবে যাদের অতিরিক্ত ওষুধ খেতে হয় বা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত তাদের অ্যান্টিবডি তৈরিতে কিছু সমস্যা হতে পারে। তবে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এটি তৈরি হয়ে যায়।
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান:
করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি সারা পৃথিবীতেই ছড়ানো হয়েছে। যার ফল হিসেবে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখছি, করোনা আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে স্বজনদের কেউ পাশে দাঁড়াচ্ছেন না। কেউ বা লাশ ফেলে পালাচ্ছেন।
ড. বিজন কুমার শীল: এটা ব্যাপক অপপ্রচারের ফল। ইওরোপ আমেরিকায় ভাইরাসের আক্রমণের বিষয়টি এমন বিভীষিকাময় ভাবে প্রচারিত হয়েছে যে মানুষের মনের গভীরে আতঙ্ক ঢুকে গিয়েছে। এক ধরনের ভীতির সঞ্চার হয়েছে, ‘আমি তাহলে আর বাঁচবো না!’ এই সব ফ্যাক্টর কিন্তু করোনা ভাইরাসের চেয়েও মারাত্মক।
আতঙ্কে অনেক স্বজন মৃতদেহ ফেলে পালাচ্ছেন। পাশাপাশি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীদের মতো মানুষেরা ঝুঁকি নিয়ে তাদের সৎকার বা দাফন করছেন। এজন্য তাদের প্রতি আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। এই কাজ পৃথিবীর অনেক দেশের স্বেচ্ছাসেবীরা করতে পারেন নি। এরচেয়ে ভালো কাজ আর কিছুই হতে পারে না।
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান:
আমরা প্রতি মাসের শুরুতেই শুনতে পাই ‘আগামী মাস হচ্ছে সংক্রমণের চূড়ান্ত সময়’ কিংবা ‘কঠোর লকডাউন প্রয়োজন’। এই ‘আগামী মাস’ কবে আসবে এবং কখন যাবে?
ড. বিজন কুমার শীল: আমি মনে করি লকডাউনের পর্যায় আমরা পেরিয়ে এসেছি। আর যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া লকডাউনও ঠিক নয়। কারণ লকডাউন দিতে হলে সেই এলাকার প্রতিটি পরিবার সম্পর্কে জানতে হবে। খাবার ও ওষুধ সরবরাহ করতে হবে। এর কিছু নিয়ম আছে তা মানতে হবে। তা না হলে লকডাউনের কারণেও বিপর্যয় তৈরি হতে পারে। যেটা ইটালিতে ঘটেছে।
বাংলাদেশে হার্ড ইমিউনিটির পর্যায় চলছে এখন। বিশেষ করে ঢাকায় অন্তত পঞ্চাশ ভাগ লোকের, আমি বলবো না তারা আক্রান্ত হয়েছেন, তবে তাদের মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গিয়েছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য আমরা এমনও অনেক উদাহরণ দেখতে পাচ্ছি, পরিবারের একজন সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু পরিবারের সব সদস্যের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গিয়েছে! ঢাকায় এখন করোনার পতনের সময় শুরু হয়েছে। ক্রমান্বয়ে চট্টগ্রাম, রাজশাহী এভাবে সারা দেশেই এর প্রকোপ কমতে থাকবে।
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান:
করোনা পরবর্তী সময়কে স্বাভাবিক অবস্থা না বলে অনেকে ‘নিউ নরমাল’বলতে চান। কেউ কেউ এখনো ফুল সেট পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকিউপমেন্ট বা পিপিই পরে সামাজিক কাজে যাচ্ছেন। অনেকে মাস্ক বা গ্লাভস নিয়ে চিন্তিত। পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে সোনা দিয়ে তৈরি মাস্কও ব্যবহার করছেন কেউ কেউ। আমাদের লাইফস্টাইলে কোন পরিবর্তনগুলো আনা প্রয়োজন?
ড. বিজন কুমার শীল: পথে বের হলে আমিও দেখি এই গরমে অনেকেই পিপিই পরে হাঁটছেন। তাদের দেখে আমার খুব মায়া লাগে। ভাইরাস কিন্তু চামড়া দিয়ে শরীরে ঢোকে না। নাক আর মুখ দিয়ে ঢোকে। তাই নাক মুখকে নিরাপদ রাখতে হবে। ২০০৩ সালে সার্স নিয়ে কাজ করার সময় কেএন৯৫মাস্ক ব্যবহার করেছি ল্যাবরেটরিতে। কিন্তু আমি তাতে স্বস্তি পাই নি। এসব মাস্ক বেশিদিন ব্যবহার করা যায় না। আর সঠিক ভাবে নিয়ম মেনে পরিষ্কার করা না হলে এসব মাস্কে ভাইরাসের উপস্থিতি থাকতেও পারে। সাধারণ চলাচলের জন্য এতো দামি মাস্কের প্রয়োজন নেই, সূতি কাপড়ের তিন লেয়ারের মাস্ক হলেই হবে। আমরা গণস্বাস্থ্য থেকে এমন মাস্ক তৈরি করেছি। কেউ চাইলে বাসাতেও বানিয়ে নিতে পারেন। এতে সুবিধা প্রতিদিন অন্যান্য কাপড়ের সাথে তা ধুয়ে নিয়ে ইস্ত্রি করে আবার ব্যবহার করা যাবে।
প্রতিদিন সকাল এবং রাতে হালকা গরম লিকার দিয়ে গার্গল করবেন। লিকারটি এতো পাতলা হবে যে কাপ বা মাগের তলা যেন দেখা যায়। এই লিকার যখন সম্ভব পান করবেন। সব সময় পানি ফুটিয়ে নেবেন, সম্ভব হলে গরম পানি পান করবেন । জিঙ্ক ও ভিটামিন সি খাবেন। গণস্বাস্থ্য থেকে জিঙ্ক ও ভিটামিন সি মিলিত একটি ওষুধ আমরা তৈরি করেছি। সবুজ শাকসবজি, দেশীয় ফলমূল প্রচুর খাবেন। এসব খাদ্য ইমিউন সিস্টেমকে সতেজ করে। যেখানে সেখানে থুতু ফেলবেন না। কেউ যদি করোনা আক্রান্ত হন তবে তার থুতুতে থাকা করোনা ভাইরাস প্রোটিনের আবরণ তৈরি করে তিনমাস পর্যন্ত টিকে যেতে পারে। ব্যবহৃত টাকার অবস্থা ভালো থাকে না। টাকা ধরার সময় সতর্ক থাকতে হবে। অনেকে টাকার গন্ধ নেন। এসব কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। কেউ কেউ গ্লাভস পরেন। এটা খারাপ কিছু নয়। নিয়মিত হাত ধোবেন। এর কোনো বিকল্প নেই। মোট কথা নিজের স্বাভাবিক নিরাপত্তা বজায় রাখবেন। করোনার ভয়ে দরজা জানালা বন্ধ রাখবেন না। কারণ বদ্ধ জায়গায় একবার করোনা ভাইরাস ঢুকলে তা দ্রুত ছড়ায়। নিজস্ব পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখবেন।
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান:
করোনার ভ্যাকসিনের কথা বলছেন অনেকেই। বাজারে ভ্যাকসিন না আসায় আতঙ্কিত বোধ করছেন কেউ কেউ। এখন ভ্যাকসিন কতোটা কার্যকর?
ড. বিজন কুমার শীল: মহামারিতে ভ্যাকসিন কোনো কাজ করে না। ভ্যাকসিন আপনি কাকে দেবেন এবং কীভাবে দেবেন সেটাও দেখতে হবে। যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং যাদের শরীরে এরই মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গিয়েছে তাদের ভ্যাকসিন দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তাহলে বাকিদের আলাদা করবেন কীভাবে? এ কারণে মহামারি শেষ হওয়ার কমপক্ষে এক থেকে দুই বছর পর ভ্যাকসিন দিতে হয়। এর আগে ব্যাপক টেস্টের মাধ্যমে দেখতে হবে ভ্যাকসিন কার প্রয়োজন আছে। কতো মানুষের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। তারপর হিসেব করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ডাবলিউএইচও এ বিষয়ে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারে।
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান:
২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের সময় আপনি সিঙ্গাপুরে ছিলেন। কাজ করেছেন সিঙ্গাপুর সরকারের সঙ্গে। সেখানে কীভাবে এসব সমস্যা সমাধান করা হয়।
ড. বিজন কুমার শীল: পৃথিবীর কোথাও ভাইরাস বা এ ধরনের মহামারি দেখা দিলে সাথে সাথেই সিঙ্গাপুরে আমরা মিটিং করতাম। যদি এই ভাইরাস সেখানে হানা দেয় তবে করণীয় ঠিক করে ফেলতাম। কোনো সিদ্ধান্তই ফেলে রাখা হতো না। সার্সের সময় প্রতিদিন দেখেছি যারা বাইরে যাচ্ছেন তাদের জ্বর মাপা হচ্ছে। বাসের বা ট্যাক্সি চালকদের প্রতিদিন সুস্থতার সার্টিফিকেট দেখিয়ে কাজে যেতে হতো। স্কুল খোলা ছিল। বাচ্চাদের সকাল এবং ছুটির সময় জ্বর মাপা হতো। কারো রোগ ধরা পড়লে তখন স্কুল বন্ধ করা হতো। সব ক্ষেত্রে যথাযথ প্রস্তুতিটা জরুরি।
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান:
এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন করতে চাই। আপনার জীবনে বহু চ্যালেঞ্জ এসেছে। জীবনে চ্যালেঞ্জকে কীভাবে দেখা উচিত?
ড. বিজন কুমার শীল: একজন মানুষের জীবনে তিনটি জিনিস ঘটবেই
এক. চ্যালেঞ্জ
দুই. আনসার্টেনিটি বা অনিশ্চয়তা এবং
তিন. মৃত্যু
যখন চ্যালেঞ্জ আসবে তখন তার কাছ থেকে পালিয়ে না গিয়ে বুদ্ধিমত্তার সাথে দেখতে হবে এ থেকে আমি কীভাবে প্রতিকার পেতে পারি। চ্যালেঞ্জ একজন মানুষকে কর্মক্ষম ও সৃজনশীল করে তোলে। আমার জীবনে আমি অনেক কিছু হারিয়েছি। কিন্তু তা নিয়ে দুঃখ না করে আমি সব সময় নতুন কিছু তৈরি করায় মনোযোগ দিয়েছি।
স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের সঙ্গে ড. বিজন কুমার শীল
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান:
দেশের বাইরে অনেক সুযোগ ও স্বীকৃতি ফেলে আপনি দেশে ফিরে এসেছেন। বাংলাদেশ নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
ড. বিজন কুমার শীল: আমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছি কাজ করার জন্য। আমি যখন দেশের বাইরে ছিলাম তখন আমার ছয়টি প্রোডাক্ট তৈরি হয়। প্রত্যেকটিই কিন্তু বাংলাদেশে এসে লঞ্চ করেছি। আমার স্ত্রী ও পরিবার প্রবাসী। আমি অনেক সময় রসিকতা করে বলি, বিজ্ঞানীদের সংসার করতে নেই। আসলে আমার পুরো সময়টা গবেষণায় কাটে। আমি বাংলাদেশের সন্তান, আমার যা দেয়ার তা এই দেশকেই দিতে হবে। সিঙ্গাপুর বা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে অনেক সুযোগ আছে কিন্তু আমি তো সে দেশের সন্তান নই। কেউ যদি আমেরিকাতে দীর্ঘদিন ধরে থাকেন তবুও তাকে বলা হয় তিনি বাংলাদেশি আমেরিকান। একজন মনীষী বলেছিলেন, ‘সবচেয়ে দুর্ভাগা হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে তার নিজ দেশে মৃত্যুবরণ করতে পারে না।’
এই দুর্ভাগা মানুষদের তালিকায় আমি নিজের নাম লেখাতে চাই না।
সম্পাদক, বিপরীত স্রোত। সাংবাদিক ও গবেষক। অ্যাসোসিয়েট ফেলো, রয়াল হিস্টোরিকাল সোসাইটি।
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত
বাতিলযোগ্য সাইবার নিরাপত্তা আই.. বিস্তারিত
বাংলাদেশ তখনো বিশ্ব ক্রিকেট অঙ.. বিস্তারিত
ব্রেদিং আউট বার্ডেন নামে কর্ম.. বিস্তারিত