ডা. আতাউর রহমান
[সুস্থ ও তারুণ্যদীপ্ত দেহ-মনের জন্যে বহুলাংশে প্রয়োজন একটি জোরদার ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। আর এই দেহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তুলতে চাই আমাদের সচেতন প্রচেষ্টা। দৈনন্দিন জীবনঅভ্যাসে নিতান্তই ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপ আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে করে তুলতে পারে অধিকতর কার্যকরী। তেমনই কিছু করণীয় ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হবে স্বাস্থ্যবিষয়ক এই রচনায়।]
পর্ব: ১
১.সুষম খাদ্যভ্যাসে কার্যকর প্রতিরক্ষা:
সঠিক ও সুষম খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হোন। কার্যকর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ এটি। যা আমাদের দেহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সর্বতোভাবে কর্মক্ষম করে তোলে। যে-কোনো ক্ষতি কাটিয়ে পুরো প্রক্রিয়াকে মেরামত ও পুনরুদ্ধার করে। নানা রকম সংক্রমণ ও অসুস্থতার বিরুদ্ধে আমাদের দেয় সংহত সুরক্ষা। সব মিলিয়ে বলা যায়, শক্তিমন্ত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি বড় উৎসই হলো সুস্থ ও বিজ্ঞানসম্মত খাদ্যাচার। আর পর্যাপ্ত ভিটামিন, খনিজ এবং আঁশ জাতীয় খাবারের অধিক্যই আমাদের প্রতিদিনের খাবারকে করে তোলে স্বাস্থ্যকর।
সেই সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাবারটা আসলে কেমন? অনেকগুলো গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, মেডিটেরেনিয়ান বা ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্যাভ্যাস এক্ষেত্রে ধন্বন্তরী। মেদস্থূলতা, হৃদরোগ, হাড়ক্ষয়, ডায়াবেটিস, পার্কিনসন্স, আলঝেইমার এমনকি ক্যান্সার প্রতিরোধে যার রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ১.৫ মিলিয়ন মানুষের ওপর বড় পরিসরে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এ খাদ্যাভ্যাস করোনারি হৃদরোগ এবং সেইসাথে অকালমৃত্যুর হার কমায়।
ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রচলিত খাদ্যতালিকায় রয়েছে মূলত ফলমূল, শাকসবজি, সালাদ, হোল গ্রেইন বা পূর্ণখাদ্যশস্য (বাদামি চাল, আটা ইত্যাদি), বাদাম, ডাল-শিম- বীজ-মটরশুঁটি জাতীয় খাবার, টক দই এবং দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, সামুদ্রিক মাছ, চর্বিহীন মাংস (ন্যূনতম)।
রেড মিট (গরু খাসি পাঁঠার মাংস), স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা ক্ষতিকর সম্পৃক্ত চর্বি এবং লবণ ও চিনির পরিমাণ এতে একেবারেই কম। সেইসাথে প্রক্রিয়াজাত ও পরিশোধিত খাবারের পরিমাণ শূন্য। এ খাবারে ফ্যাট বা চর্বির প্রাথমিক যোগানটা আসে অলিভ অয়েল বা জলপাই তেল থেকে, যা মনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড বা হৃৎবান্ধব অসম্পৃক্ত চর্বির সমৃদ্ধ উৎস। জানা ভালো, এটি ক্ষতিকর এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। আর ভিটামিন ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ বলে এসব খাবার ক্যান্সার প্রতিরোধ করে ও বার্ধক্যজনিত রোগঝুঁকি কমায়। বাড়ায় মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা।
এক কথায় বলা যেতে পারে, ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্যতালিকার অন্যতম উপাদান হলো তাজা ফলমূল ও শাকসবজিসহ অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ প্রাকৃতিক খাদ্যদ্রব্য, সবদিক থেকেই যা আমাদের দেহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে করে তোলে অধিকতর কর্মক্ষম ও সুস্থ।
২.রঙিন ফলমূল ও শাকসবজিতে নীরোগ দেহ:
হরেক রকম ও ধরনের রঙিন ফলমূল-শাকসবজি থেকে যে পুষ্টিবৈচিত্র্য আমরা পাই, এক কথায় সেটা অতুলনীয়। স্বাস্থ্য-গবেষকদের মতে, প্রতিদিন পাঁচ থেকে নয় প্রকারের ফল ও শাকসবজি খান। এর ভিটামিন, খনিজ, আঁশ ও বার্ধক্য-প্রতিরোধী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বাড়াবে আপনার রোগ প্রতিহত করার ক্ষমতা। সুস্থ থাকবেন আপনি। তাই প্রতিবেলার খাবারে অন্তত দুই ভিন্ন রঙের শাকসবজি ও ফলমূল রাখুন।
জানা ভালো, প্রত্যেক ভিন্ন রংবিশিষ্ট ফল-সবজির মধ্যেই রয়েছে অসাধারণ সব স্বাস্থ্য-হিতকরি উপাদান। সেজন্যেই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো, দৈনন্দিন খাবারে ফল-সবজির রংধনু সাজান। এই বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক খাদ্যসম্ভার আপনার দেহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে করবে অধিকতর জোরদার।
লাল: টমেটো, তরমুজ, ডালিম, স্ট্রবেরি, আপেল, লাল মূলা ও শালগম, লাল বাঁধাকপি, লাল কিডনি বিন, গোলমরিচ ইত্যাদি। এ ধরনের খাবারে থাকা বিভিন্ন উপাদান যেমন : লাইকোপিন, অ্যান্থোসায়ানিন প্রোস্টেট ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, শরীরের যে-কোনো অংশে টিউমার ও উচ্চ কোলেস্টেরলের ঝুঁকি হ্রাস করে। ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিকেলের বিনাশ ঘটায়। বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগের উপশমেও এসবের রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। সূর্যরশ্মি থেকে ত্বককে সুরক্ষা দেয়। আর্থ্রাইটিস রোগীদের ক্ষেত্রে অস্থিসন্ধির প্রদাহ কমায়।
কমলা ও হলুদ: আম, কমলা, পেঁপে, অ্যাপ্রিকট, আনারস, কলা, কামরাঙা, গাজর, মিষ্টি কুমড়া, ভূট্টা, স্কোয়াশ ইত্যাদি। মিষ্টি আলুকেও এই দলেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন পুষ্টিবিদরা। প্রচুর বিটা ক্যারোটিনের পাশাপাশি পটাশিয়াম ও ভিটামিন এ পাওয়া যায় এসব খাবারে। এসব খাবার বয়সজনিত চোখের রোগ ম্যাকুলার ডিজেনারেশন ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। কোলেস্টেরল ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। শরীরের বিভিন্ন জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধিকে সুস্থ রাখে। ফ্রি র্যাডিকেলের পরিমাণ কমায়। ম্যাগনেশিয়াম ও ক্যালসিয়ামের যোগান দিয়ে হাড়কে সুরক্ষিত রাখে।
সাদা: মাশরুম, ফুলকপি, সাদা মূলা ও শালগম, রসুন ইত্যাদি। এ রংয়ের ফল-সবজিগুলো দেহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ সৈনিক এবং ক্যান্সার প্রতিরোধী ন্যাচারাল কিলার সেলের (বি ও টি সেল) কর্মসক্ষমতা বাড়ায়। ফলে অন্ত্র, স্তন, প্রোস্টেট ও হরমোন সংক্রান্ত ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। সেইসাথে হরমোন প্রবাহে আসে ভারসাম্যতা। ঘন ঘন জ্বর, সর্দি ও ঠাণ্ডা লাগার প্রবণতা আছে যাদের, তাদের জন্যে সাদা রংবিশিষ্ট ফল-সবজি বেশ উপকারি।
সবুজ: পালংসহ নানা ধরনের শাক, লেটুস, লাউ, বাঁধাকপি, মটরশুঁটি ইত্যাদি। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে চাঙ্গা রাখে বলে এগুলো ঘুরেফিরে খাওয়া চাই প্রতিদিনই। ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম ও আয়রন পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে এসব খাবারে। কোলেস্টেরল ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ক্যান্সার ঝুঁকি কমায়। হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এসব খাবারে থাকা ‘ল্যুটিন’ ও ‘জিয়াক্স্যানথিন’ চোখের জন্যে উপকারি। রেটিনা সুস্থ রাখে এবং দৃষ্টিশক্তির উন্নতি ঘটায়। মনে রাখতে হবে, সবুজ পাতাযুক্ত শাকসবজির রং যত গাঢ় হবে পুষ্টি ও উপকারিতাও মিলবে তত বেশি।
নীল ও বেগুনি: জাম, কিশমিশ, রঙিন আঙুর, পেঁয়াজ, বেগুন, বিট ইত্যাদি। হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটায়। পরিপাকতন্ত্রের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। আলঝেইমার অর্থাৎ বয়সজনিত স্মৃতিভ্রষ্টতার ঝুঁকি কমায়। বার্ধক্যগতিকে ধীর করে। মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ-ঝুঁকি কমায় ও মাড়িকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
৩.টক দই প্রতিদিন:
টক দই খান প্রতিদিন। সকালের নাশতায়, ডেজার্ট হিসেবে বা যে-কোনো সময়। সালাদ কিংবা স্মুদির সাথেও চলতে পারে। নিয়মিত টক দই খেলে ইনফেকশনের ঝুঁকি কমে। কারণ এতে থাকে প্রো-বায়োটিকস অর্থাৎ হিতকরি ব্যাকটেরিয়া। যা পরিপাকতন্ত্রের রোগ প্রতিরোধী কোষগুলোকে উজ্জীবিত করে ও এসব কোষের উৎপাদন বাড়ায়। একইসাথে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও বিষাক্ত বস্তুকণাদের প্রতিহত করে। সবমিলিয়ে পরিপাকতন্ত্রকে সুস্থ ও কর্মচঞ্চল থাকতে সাহায্য করে।
অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৩ জন মহিলার ওপর পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, দু’সপ্তাহ ধরে যারা প্রতিদিন টক দই খেয়েছেন তাদের দেহে রোগ প্রতিরোধে সিদ্ধহস্ত ‘টি লিম্ফোসাইট’-এর পরিমাণ বেড়ে গেছে ৩০ শতাংশ।
টক দইতে প্রচুর ক্যালসিয়াম থাকে বলে এটা হাড় ও দাঁতের সুরক্ষায় এটা দারুণ উপকারি। পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের পাশাপাশি ভিটামিন বি ও ফসফরাস পাওয়া যায়। এছাড়াও থাকে পর্যাপ্ত প্রোটিন। হৃৎপিন্ডের সুরক্ষায় বেশ কার্যকরী। ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
পরবর্তী পর্ব ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবে
মেডিকেল কাউন্সিলর অ্যান্ড মোটিভিয়ার, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত
বাতিলযোগ্য সাইবার নিরাপত্তা আই.. বিস্তারিত
বাংলাদেশ তখনো বিশ্ব ক্রিকেট অঙ.. বিস্তারিত
ব্রেদিং আউট বার্ডেন নামে কর্ম.. বিস্তারিত