ডা. আতাউর রহমান
[সুস্থ ও তারুণ্যদীপ্ত দেহ-মনের জন্যে বহুলাংশে প্রয়োজন একটি জোরদার ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। আর এই দেহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তুলতে চাই আমাদের সচেতন প্রচেষ্টা। দৈনন্দিন জীবন অভ্যাসে নিতান্তই ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপ আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে করে তুলতে পারে অধিকতর কার্যকরী। তেমনই কিছু করণীয় ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হবে স্বাস্থ্যবিষয়ক এই রচনায়।]
পর্ব ২ :
৪. লেবু-পানিতে দেহক্ষয় রোধ:
প্রতিদিন সকালে হালকা গরম লেবু-পানি পান করুন। দিনের শুরুতেই আধা লিটার পানিতে একটি লেবুর রস (পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্যে) মিশিয়ে পান করলে তা সারা দিনের জন্যে আপনার হজম-প্রক্রিয়াকে করে তুলবে প্রস্তুত এবং বিপাকক্রিয়াকে (মেটাবলিজম) করবে ত্বরান্বিত। পাশাপাশি দেহ-সুরক্ষা ব্যবস্থাকেও চাঙ্গা করে তুলতে লেবু-পানি এক মোক্ষম দাওয়াই। তবে তা পান করতে হবে নাশতার অন্তত ১৫/২০ মিনিট আগেই। জানা চাই, ভিটামিন সি’র পাশাপাশি পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়ামেরও সমৃদ্ধ উৎস এই লেবু।
লেবুতে থাকে বায়ো-ফ্ল্যাভোনয়েডস। পরিবেশ দূষণের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি থেকে এটি দেহকোষগুলোকে সুরক্ষা দেয়। কীভাবে? প্রতিটি দেহকোষের আবরণ (সেল মেমব্রেন) ঘেঁষে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কিছুটা ফাঁকা জায়গা থাকে, একে বলে রিসিপ্টর সাইট। নানা রকম টক্সিন, জীবাণু ও দূষিত পদার্থ একটু একটু করে জমা হয় এই রিসিপ্টর সাইটে। ক্রমান্বয়ে তা সেই কোষের ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং সংশ্লিষ্ট দেহকোষের ক্ষতিসাধন করে। আর এই ফাঁকা স্থান অর্থাৎ রিসিপ্টর সাইটে আগেই আসন গেড়ে শক্ত অবস্থান নেয় বায়ো-ফ্ল্যাভোনয়েডস, ফলে জীবাণু কিংবা টক্সিন আর তেমন সুবিধা করতে পারে না। সবমিলিয়ে বলা যায়, এ পানীয়টি শরীরকে বিশেষত লিভারকে ডিটক্সিফাই বা দূষণমুক্ত করে।
এছাড়াও বায়ো-ফ্ল্যাভোনয়েডস রক্তের মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টেরলকে বাধা দেয় ধমনীর ভেতর-দেয়ালে আস্তর তৈরিতে এবং সেইসাথে ধমনীর অভ্যন্তরে রক্ত জমাট বাঁধা ঠেকায়। ফলে করোনারি হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে। গবেষণায় প্রমাণিত, যাদের খাদ্যতালিকায় থাকে বায়ো-ফ্ল্যাভোনয়েডসের আধিক্য, করোনারি হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার হার তাদের তত কম।
লেবু-পানি ত্বক ভালো রাখে। ত্বকের নানা রকম অ্যালার্জি, র্যাশ বা ফুসকুড়ি, বলিরেখা ইত্যাদি থেকে মুক্তি পেতেও এটি কার্যকর। ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা বা সর্দি প্রতিরোধ ও প্রতিকারে তো বটেই; এর পাশাপাশি অস্থিসন্ধি, পেশি, দাঁতের কিছু কিছু ব্যথা কমানো এবং মাড়িতে সংক্রমণ প্রতিরোধেও এ এক মোক্ষম দাওয়াই। শুধু তা-ই নয়, ব্যাকটেরিয়া-প্রতিরোধী ভূমিকার কারণে যে-কোনো সংক্রমণের বিরুদ্ধেই (শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, গলা ব্যথা, টনসিলের প্রদাহ ইত্যাদি) এটি হতে পারে একটি দৈনন্দিন প্রতিকার ব্যবস্থা।
মানবদেহে এসিড-অ্যালকালি বা অম্ল-ক্ষারের ভারসাম্য রক্ষায় অর্থাৎ পি-এইচ মান ঠিক রাখতেও লেবুর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দিনের শুরুতে তাজা লেবুর রসযুক্ত ঈষদুষ্ণ পানি আপনার দেহে সঠিক পি-এইচ মান বজায় রাখে। যার ফলে দেহের উপকারী অণুজীবগুলো (নরমাল ফ্লোরা) থাকে অক্ষত ও কার্যকর। অন্যদিকে অম্ল-ক্ষারের এ ভারসাম্য বজায় না থাকলে অর্থাৎ দেহের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ অম্লপ্রধান বা এসিডিক হয়ে উঠলে বাড়ে ক্ষতিকর ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার দৌরাত্ম্য। দেহে অ্যালকালাইন বা ক্ষারীয় অবস্থা বজায় রাখার জন্যে আরেকটি অনবদ্য উপাদান হলো অ্যাপল সাইডার ভিনেগার, তবে স্বাদ ও সহজলভ্যতার দিক থেকে লেবু-পানি ঢের উত্তম, তা বলাই বাহুল্য।
লেবু চা পান এবং সালাদ ড্রেসিংয়ে ভিনেগারের বদলে কিংবা যে-কোনো রান্নায় লেবুর ব্যবহারও দারুণ উপকারী। লেবু-পানি ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। স্বাভাবিক রেচনক্রিয়া অব্যাহত রাখতে সক্ষম।
উল্লেখ্য, যারা পাকস্থলির আলসার বা এ জাতীয় সমস্যায় ভুগছেন তারা সকালে খালি পেটে লেবু-পানি পানের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করবেন।
৫.দেহে অ্যালকালাইন বা ক্ষারীয় পরিবেশ রক্ষা জরুরি:
দেহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সর্বোচ্চ কার্যকর থাকে, যখন দেহে বজায় থাকে অ্যালকালাইন বা ক্ষারীয় অবস্থা। অধিকাংশ ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়াই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এসিডিক অর্থাৎ অম্লপ্রধান পরিবেশে, আর অ্যালকালাইন পরিস্থিতিতে ওরা পড়ে ভীষণ বিপদে। তাই যখনই কাজে-কর্মে কিছুটা দুর্বলতা ও শৈথিল্য অনুভব করছেন বলে মনে হচ্ছে -গাঢ় ও সবুজ রংবিশিষ্ট শাকসবজি, বীজ জাতীয় খাবার ও তাজা ফলমূল খান আর সেইসাথে পান করুন পর্যাপ্ত পানি। চিনি, মিষ্টি জাতীয় ও প্রক্রিয়াজাত এবং ভাজাপোড়া-মসলাদার খাবার ও অ্যালকোহল বর্জন করুন। নিয়মিত ব্যায়াম করুন। এসিডিক অবস্থা কেটে গিয়ে দেহে অ্যালকালাইন পরিবেশ সৃষ্টি হবে। দেহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও হয়ে উঠবে চনমনে।
কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো পানি, যা বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান দেহকোষগুলোতে পৌঁছে দেয় এবং টক্সিন, ব্যাকটেরিয়াসহ নানা ধরনের দূষিত ও বর্জ্য পদার্থ কোষ থেকে ধুয়ে-ঝাঁটিয়ে শরীর থেকে বের করে দেয়। পর্যাপ্ত পানি পান দেহের তাপমাত্রাকে স্থিতিশীল রাখে। অস্থিসন্ধিকে সুরক্ষা দেয় এবং মুখ-গহ্বরকে রাখে আর্দ্র ও সিক্ত। ঠাণ্ডা-সর্দির প্রকোপ কমায়।
তৃষ্ণার্ত হয়েছেন, তারপর পানি পান করবেন-এটা ভালো অভ্যাস নয়। কারণ তৃষ্ণা পাওয়ার পর যখন আপনার মাথাব্যথা হচ্ছে, প্রস্রাবের রং হয়েছে গাঢ় হলুদ, তার মানে আপনি ইতোমধ্যেই পানিশূন্যতায় ভুগতে শুরু করেছেন! তাই আপনার স্বাভাবিক শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্যে চাই পানির অবিরল প্রবাহ। সাধারণভাবে বিশেষজ্ঞদের মত হলো, প্রতিদিন দেড় থেকে দুই লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। তবে উষ্ণ আবহাওয়া, অতিরিক্ত ঘাম নিঃসরণ, ভারী ব্যায়াম কিংবা দৈহিক পরিশ্রম ভেদে পানি পানের পরিমাণ আনুপাতিক হারে বাড়ানো জরুরি।
আর
বিশুদ্ধ পানি পানের কোনো বিকল্প নেই। অন্যথা হলে নানা রকম জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
৬. প্রি-বায়োটিকস ও প্রো-বায়োটিকস:
প্রি-বায়োটিকস ও প্রো-বায়োটিকস। দুটোই আমাদের শরীরের জন্যে উপকারী। প্রি-বায়োটিকস এক ধরনের প্রাকৃতিক আঁশ (চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ফ্রুক্টো-অলিগো-স্যাকারাইড), যা স্বাস্থ্য-হিতকরি ব্যাকটেরিয়াদের পুষ্টি যোগায় এবং তাদের কাজে সহযোগিতা করে। রসুন, পেঁয়াজ, পালং শাক, মটরশুঁটি, শিমবিচি, মসূর ডাল, ওট, বার্লি, কলা ইত্যাদি প্রি-বায়োটিকস সমৃদ্ধ খাবার আপনার পরিপাকতন্ত্র ও দেহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দারুণভাবে চাঙ্গা করে। তবে প্রি-বায়োটিকসের যোগান সবচেয়ে ভালোভাবে পাওয়া যায় সকালের নাশতায় বাটিভর্তি ওটমিল, পরিজ, ঢেঁকিছাঁটা গম ও পূর্ণশস্যদানা জাতীয় খাবার গ্রহণে, যা আপনার ইমিউন সিস্টেমে যোগ করে বাড়তি শক্তি।
‘প্রো-বায়োটিকস’ শব্দটাও ইদানীং অনেকের কাছেই বেশ পরিচিত। বিভিন্ন ধরনের প্রো-বায়োটিকস রয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে সহজলভ্য ও সার্বজনীন হলো ‘ল্যাকটোব্যাসিলাস অ্যাসিডোফিলাস’, প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে তৈরি টক দইতে যা সহজে মেলে।
পরবর্তী পর্ব ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবে
মেডিকেল কাউন্সিলর অ্যান্ড মোটিভিয়ার, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
সাংবাদিক শফিক রেহমানের পুরো বক.. বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত
বাতিলযোগ্য সাইবার নিরাপত্তা আই.. বিস্তারিত
বাংলাদেশ তখনো বিশ্ব ক্রিকেট অঙ.. বিস্তারিত