ডা. আতাউর রহমান
[সুস্থ
ও তারুণ্যদীপ্ত দেহ-মনের জন্যে বহুলাংশে প্রয়োজন একটি জোরদার ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। আর এই দেহ প্রতিরক্ষা
ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তুলতে চাই আমাদের সচেতন প্রচেষ্টা। দৈনন্দিন
জীবনঅভ্যাসে নিতান্তই ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপ আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে করে তুলতে পারে অধিকতর কার্যকরী। তেমনই
কিছু করণীয় ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হবে স্বাস্থ্যবিষয়ক এই রচনায়।]
পর্ব : ৫
১৩. খাদ্যতালিকায় চাই প্রোটিন, তবে স্বাস্থ্যকর :
প্রোটিনের নানা গুণপনার কথা আমরা কমবেশি সকলেই জানি। যেমন: সুষম খাদ্যাভ্যাসের একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ এটি, শরীর গঠনে বিশেষত পেশি গঠনে প্রোটিনের সক্রিয় ভূমিকা ইত্যাদি। এসবের পাশাপাশি
প্রোটিন কিন্তু কার্যকর দেহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকও বটে।
তাই প্রতিবেলার খাবারে রাখুন পর্যাপ্ত প্রোটিন। কারণ প্রোটিনে
থাকে অ্যামাইনো এসিড, যা রোগ প্রতিরোধে সহায়ক অ্যান্টিবডি ও অন্যান্য কোষগুলো-সহ আমাদের সব দেহকোষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গাঠনিক উপাদান। দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় যদি প্রোটিনের ঘাটতি হয় তবে দেহে হ্রাস পেতে পারে শ্বেতকণিকার উৎপাদন, যা রোগ সংক্রমণের জন্যে দায়ী অ্যান্টিজেনগুলোর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সহজ কথায়, আমাদের ইমিউন সেল বা রোগ প্রতিরোধী
কোষগুলো প্রোটিনের ওপর নির্ভরশীল।
রোগ প্রতিরোধী কোষগুলো নিজেদের সংখ্যাবৃদ্ধির মাধ্যমে নানা রকম জীবাণুর বিরুদ্ধে তাদের লড়াই চালিয়ে যায়। আর এ কোষগুলোর বংশবৃদ্ধির জন্যে শরীরে দরকার প্রোটিন ও এমাইনো এসিড। এর পাশাপাশি প্রোটিন রক্তে চিনির ভারসাম্য রক্ষা করে এবং রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় অ্যালকালাইন পরিবেশ বজায় রাখে দেহে।
এছাড়াও খাদ্যতালিকায় প্রোটিনের পরিমাণ কম হলে সাধারণত দেখা যায়, শর্করাটা খাওয়া হয়ে যায় তুলনামূলক বেশি। বিশেষত পরিশোধিত শর্করা বা রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট, যা হজম প্রক্রিয়ায়
দ্রুত গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়। এতে রক্তে চিনির পরিমাণ যায় বেড়ে। ফলে প্যানক্রিয়াসের ওপর কিছুটা অতিরিক্ত চাপ পড়ে। বাধাগ্রস্ত হয় ইমিউন সিস্টেমের স্বাভাবিক কর্মপ্রক্রিয়া।
কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট আপনার শরীর যেমনভাবে সংরক্ষণ করতে পারে, প্রোটিনের বেলায় ঠিক তেমনটা ঘটে না। তাই শরীরে প্রোটিনের অব্যাহত সরবরাহ থাকা বাঞ্চনীয়। যে-কারণে প্রতিবেলার খাবারে ভালো মানের প্রোটিন রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন গবেষকরা।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, পর্যাপ্ত প্রোটিন গ্রহণ করতে গিয়ে খাদ্যে সম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যাওয়াটা মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত হবে না। সবচেয়ে ভালো হয় যদি মাছ বিশেষত সামুদ্রিক মাছ, মুরগির মাংস (চামড়া ছাড়া), ডিম, বিভিন্ন ধরনের ডাল, সয়া ইত্যাদি থেকে প্রোটিন গ্রহণ করা যায়। উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবারগুলো হলো দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, গম, স্পিরুলিনা বা সামুদ্রিক শৈবাল, সবুজ পাতাযুক্ত শাকসবজি, নানা রকম বাদাম ও বীজ ইত্যাদি।
আবার এত বেশি প্রোটিন গ্রহণ করাও স্বাস্থ্যকর বলে বিবেচিত হবে না, যার দরুন হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়তে পারে। তাই একই বেলার খাবারে পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যবান্ধব শর্করা ও ফ্যাট গ্রহণের ব্যাপারে সচেষ্ট থাকুন। তাতে খাবারের পুষ্টিমানে ভারসাম্য বজায় থাকবে।
পথ্যবিদরা বলেন, একজন পূর্ণবয়সী মানুষের দৈনিক মোট ক্যালরি গ্রহণের প্রায় চার ভাগের একভাগ অর্থাৎ ২৫ শতাংশের উৎস প্রোটিন হলে ভালো হয়। ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আসবে ফ্যাটযুক্ত (স্বাস্থ্য-হিতকরি ফ্যাট) খাবার থেকে এবং বাকিটা আসবে পূর্ণ খাদ্যশস্য, তাজা ফলমূল ও শাকসবজি থেকে।
১৪. অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট : ইমিউন সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ সৈনিক
আপনার প্রতিদিনকার খাবারটা হোক অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর, তাতে আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা হবে দিন দিন আরো সংহত ও শক্তপোক্ত।
কেন দরকার এই অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট? কেনই বা এত গুরুত্বপূর্ণ এটি?
ধূমপান, পরিবেশ দূষণ, নানা রকম রেডিয়েশন বা বিকিরণের প্রভাবে এবং উচ্চ তাপে ভাজা-পোড়া-রান্নাকৃত খাবার গ্রহণ আর অক্সিডেশন প্রক্রিয়ার দরুণ শরীরে সৃষ্টি হয় ফ্রি-র্যাডিকেল নামক টক্সিন বা বিষাণু, যা দেহকোষকে ধরাশায়ী করে এবং বিভিন্ন প্রকার রোগব্যাধির (হৃদরোগ, ক্যান্সার-সহ নানা রকম দুরারোগ্য ব্যাধি) সূত্রপাত ঘটাতে সক্ষম। ভাগ্যিস, প্রকৃতি আমাদের জন্যে কিছু অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট মজুত রেখেছে, যা টক্সিন ও রোগব্যাধির বিরুদ্ধে দেহকে সুরক্ষা দেয়। দেহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে মজবুত করে তুলতে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের রয়েছে অবিশ্বাস্যরকম ভূমিকা।
অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট দেহের ফ্রি র্যাডিকেলগুলোকে নিরস্ত্র করে, রোধ করে দেহকোষের ক্ষয়। অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের মধ্যে রয়েছে মূলত হরেক রকমের ভিটামিন-মিনারেলসহ অনন্য কিছু প্রাকৃতিক উপাদান, যেমন : ভিটামিন এ, বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, জিংক, সেলেনিয়াম, বিটা ক্যারোটিন, লাইকোপিন (টমেটো কাঁচা খেলে সবচেয়ে ভালো মেলে), ল্যুটিন, জিয়াক্স্যানথিন
ইত্যাদি। এদের মধ্যে আবার ভিটামিন সি হলো অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের প্রধান উৎস। কারণ ব্যাকটেরিয়া
ও ভাইরাস দুয়ের বিরুদ্ধেই এটি সমান আক্রমণাত্মক।
ভিটামিন সি একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টি-হিস্টামিন, যা শরীরের যে-কোনো অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া দমনে সিদ্ধহস্ত। শরীরের যে-কোনো ক্ষত নিরাময়েও ভিটামিন সি সদা তৎপর। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় মোটামুটি পাঁচ/ ছয় ধরনের তাজা ফল ও সবজি থাকলে ২০০ মিলিগ্রামের মতো ভিটামিন সি আমরা পেয়ে থাকি। উল্লেখ্য, একজন পূর্ণবয়সী মানুষের শরীরে ভিটামিন সি’র দৈনিক চাহিদা ৬৫ থেকে ৯০ মিলিগ্রাম, সর্বোচ্চ নিরাপদ মাত্রা ২০০০ মিলিগ্রাম (২ গ্রাম)। অতিরিক্ত ভিটামিন সি শরীর সংরক্ষণ করে রাখতে পারে না। তাই প্রতিদিনের খাবারে এটি থাকা বাঞ্চনীয়। তবে অতিরিক্ত
যেন কোনোভাবেই না হয়।
উচ্চ মাত্রার ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল-সবজিগুলো হলো : সাইট্রাসযুক্ত ফল (লেবু আমলকি জাম্বুরা কমলা মাল্টা ইত্যাদি), পেঁপে তরমুজ আম জাম আপেল পেয়ারা ডালিম নাশপাতি আঙুর কিউই স্ট্রবেরি
আলু ব্রকোলি গাজর টমেটো বিট মিষ্টিকুমড়া মরিচ ও পালং শাক-সহ বিভিন্ন গাঢ় সবুজ শাক-সবজি।
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ আরেকটি সবজি হলো রেড ক্যাবেজ বা লাল বাঁধাকপি (নামে লাল, দেখতে কিন্তু বেগুণি)। প্রচুর অ্যান্থোসায়ানিন রয়েছে বলে সাধারণ বাঁধাকপির তুলনায় এতে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের পরিমাণ চার গুণ বেশি।
এসবের পাশাপাশি কলা, ডুমুর, লেটুস, মিষ্টি আলু, পূর্ণ খাদ্যশস্য, নানা রকম বাদাম, বীজ ও মশলা অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের সমৃদ্ধ ও প্রাকৃতিক উৎস।
তাই আপনার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের যোগান ঠিক রাখতে স্ন্যাকস হিসেবে মুঠোভর্তি ফল ও বাদাম খান। দুপুর ও রাতের খাবারে রাখুন পূর্ণ খাদ্যশস্যযুক্ত শর্করা ও দু/ তিন ধরনের সবজি।
১৫. প্রতিদিন একটি গাজর খান :
গাজর খেলে দৃষ্টিশক্তি বাড়ে, কমে চোখে ছানি পড়ার সম্ভাবনা, রাতকানা রোগ প্রতিরোধেও এটি কার্যকর Ñ কথাগুলো এখন কমবেশি সবাই জানেন। সাম্প্রতিক গবেষণাও ইদানীং বলছে, বিটা ক্যারোটিনে ভরপুর গাজর নিয়মিত খেলে রাতের দৃষ্টি তো স্বচ্ছ হয়ই, সামগ্রিকভাবে বাড়ে দৃষ্টিশক্তির প্রখরতাও। উপরন্তু নিঃশ্বাস
হয়ে ওঠে সজীব। পাশাপাশি দেহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হয় সংহত।
গবেষণায় দেখা গেছে, গাজরে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বিটা ক্যারোটিন হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। সেইসাথে কমায় স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের
ঝুঁকি। পথ্যবিদরা বলছেন, দিনে একটি করে গাজর খান, হার্ট সার্জনকে দূরে রাখুন। ত্বক ও চুলের জন্যেও গাজর উপকারি।
বিটা ক্যারোটিন বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের বিরুদ্ধেও দারুণ কার্যকর। এটি দেহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সৈনিক ম্যাক্রোফেজকে উজ্জীবিত
করে, যার ফলে তৈরি হয় টিউমার নেকরোসিস ফ্যাক্টর যা ক্যান্সার সেলের বিনাশ ঘটায়। গাজর ছাড়াও বিটা ক্যারেটিন মেলে প্রধানত রঙিন (হলুদ ও কমলা) ফল ও সবজি, যেমন : টমেটো, আম, মিষ্টি আলু, গোলমরিচ এবং গাঢ় রঙের সবজি, যেমন : পালং শাক, ব্রকোলি ইত্যাদিতে।
ভিটামিন এ-র (দৈনিক চাহিদার ৭৩ শতাংশ রয়েছে একটি স্বাভাবিক আকৃতির গাজরে) পাশাপাশি গাজরে রয়েছে ভিটামিন বি ৬ ও ভিটামিন কে। আরো আছে নানা রকম মিনারেল বা খনিজ। রয়েছে আঁশ বা খাদ্যতন্তু, তাই কোষ্ঠবদ্ধতা প্রশমন ও নিরাময়ে এটি সহায়ক। এ কারণে কোলন ক্যান্সার রোধে এর ভূমিকা রয়েছে। মস্তিষ্কের জন্যেও এটি উপকারি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্যেই গাজর বিশেষভাবে হিতকরি। পুরুষদের উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি ও শুক্রাণুর গুণগত মান উন্নয়নে এর কার্যকারিতার প্রমাণ মিলেছে। নারীদের রক্তস্রাবজনিত জটিলতা, যেমন : অনিয়মিত মাসিক, অতিরিক্ত
রক্তক্ষরণ ইত্যাদি সমস্যা নিরসনে প্রতিদিন একটি করে গাজর খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সেইসাথে নিয়মিত গাজর খাওয়ার ফলে পোস্ট মেনোপোজাল বা রজঃনিবৃত্তি পরবর্তী অস্বস্তি, যেমন : হট ফ্লাশ, মুড পরিবর্তন ইত্যাদি সমস্যার অবসান ঘটে বলে জানা গেছে।
প্রতিদিন একটি গাজর খান। কাঁচা খেতে পারেন মূল খাবারের আগে বা পরে। এছাড়াও গাজর সহযোগে তৈরি করা যেতে পারে স্বাস্থ্যকর ভেজিটেবল স্যুপ।
মেডিকেল কাউন্সিলর অ্যান্ড মোটিভিয়ার, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত
বাতিলযোগ্য সাইবার নিরাপত্তা আই.. বিস্তারিত
বাংলাদেশ তখনো বিশ্ব ক্রিকেট অঙ.. বিস্তারিত
ব্রেদিং আউট বার্ডেন নামে কর্ম.. বিস্তারিত