English
ঢাকা, বুধবার, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫ মাঘ ১৪৩১

প্রকাশঃ ২০২০-১১-০৯ ০০:৫১:৪৪
আপডেটঃ ২০২৫-০১-২৮ ০০:৩৭:১২


অল্প স্বল্প জীবনের গল্প

অল্প স্বল্প জীবনের গল্প

নাহিদ আহসান

 

ঘুড়িরা উড়ছে

আগা খান ট্রেনিংয়ের তৃতীয় দিনে ট্রেইনার ফাতেমা আপা আমাদের ভিন্ন একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন সেখান গিয়ে দেখি রঙিন কাগজ, কাঠি, বেতের কাটা অংশ, পুতি, জরি, গ্লি¬টার সব জড় করা তিনি বললেন আমাদেরকে একটি পরীক্ষা দিতে হবে আমরা কী রকম লার্নার বা শিক্ষার্থী তিনি এতে বুঝতে পারবেন

তিনি প্রথমে ঘুড়ি বানাবেন কিন্তু মুখে কিছু বলবেন না তাকে দেখে কতজন ঘুড়ি বানাতে পারে তাই তিনি পরীক্ষা করবেন দ্বিতীয়বার তিনি মুখেও বলবেন, হাতে কলমে করেও দেখাবেন যারা প্রথমবার পারে নি তারা নিশ্চয়ই পরের বার পারবে

কিন্তু দুঃখের বিষয় তিনি এতো দ্রুত বানালেন আমি কিছুই বুঝলাম না কিন্তু অনেকেই দেখি এর মধ্যে বানিয়ে ফেলেছে তাজ্জব ব্যাপার পরের বার বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম আমার ঘুড়ি বানানোর মাঝ পথে সবাই বানিয়ে জমা দিয়েছে সময়ও শেষ

তিনি যারা জমা দিয়েছে তাদেরকে ছুটি দিয়ে দিলেন

আমাদের কাছ থেকে পুরনো ম্যাটেরিয়াল জমা নিয়ে নতুন সব কিছু দিলেন বললেন, তোমরা পাশ করতে পার নি

এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম

তিনি আরও বললেন, ঘুড়ি বানিয়ে জমা দিলে তবেই তোমরা ছুটি পাবে

আমিসহ পাঁচজন নত মুখে বসে চেষ্টা চালিয়ে গেলাম শেষ পর্যন্ত আমার ঘুড়ি যা দাঁড়াল তা দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম কিম্ভুতকিমাকার বেগুনি রঙের এক বিশাল মাছ যার গলায় লাল পুতির মালা লেজে নুপুর যাই হোক জমা দেয়া নিয়ে কথা কে আর দেখতে যাচ্ছে!

কিন্তু পরের দিন শুনলাম, প্রদর্শনী হবে সবার নাম এবং ছবিও থাকবে সাথে

এই কথা শুনে আমারতো খুশি হওয়ার কথা প্রদর্শনীতে যাচ্ছে শিল্পকর্ম কিন্তু আমি চোখে সর্ষেফুল দেখতে লাগলাম

যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়

অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর

সব বাগধারা মনে পড়তে লাগলো

যাই হোক শুধু আমরা পঁচিশ জন ট্রেইনিই নই অনেকেই এলেন হলরুমে ম্যাডাম বক্তব্য শুরু করলেন সবার ঘুড়ি দেয়ালে বোর্ডে কয়েকজনের জনের ঘুড়ি এক রকম যেন ইউনিফর্ম পরে আছে সবাই

আমাদের ঘুড়িগুলো আলাদা বেশি রঙিন ম্যাডাম বললেন,যারা প্রথমবারে পাশ করেছ তারা তুখোড় মেধাবী পলকে সব কিছু বুঝে ফেল যারা দ্বিতীয়বারে পাশ করেছ তারাও মেধাবী শুধু তাদেরকে একটু বুঝিয়ে বলতে হয় আর যারা ফেল করেছ, তারা যে মেধাহীন তা নয় তবে তাদের মেধার ধরন আলাদা প্রচলিত নিয়ম কানুন বুঝে উঠতে তাদের সময় লাগে তাই তারা অকৃতকার্য  হয় অনেক ক্ষেত্রে তবে তারা নতুন নিয়ম কানুন তৈরি করতে পারে ওরা হচ্ছে সৃজনশীল

সবাই হাততালি দিল এতোক্ষণে আমাদের মুখে হাসি ফুটে উঠল

আজকাল প্রায়ই শুনি, দৃষ্টিভঙ্গি বদলান জীবন বদলে যাবে

তবে ম্যাডামের কথা শুনে আক্ষরিক অর্থেই আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলালো কেন না এতোক্ষণ ভীত দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়েছিলাম, এখন ভালো ভাবে তাকালাম হায় মানুষের কথার ক্ষমতা!

আমার আত্মবিশ্বাস ফিরে এলো

 

আকাশে শান্তির নীড়

একবার ঈদে ঢাকায় ফিরছিলাম বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য দুঘণ্টা এয়ারপোর্টে দেরি হলো প্লে¬নের ভেতরেও অনেকক্ষণ বসে থাকতে হলো

সত্তর ঊর্ধ্ব বয়সের একজন ভদ্রলোক খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন, তিনি ঠিক মতো দেশে ফিরতে পারবেন তো? নাকি মাঝপথে বিমান ভেঙে পড়বে? এইসব ভেবে

বিমানবালা ধমক দিচ্ছিলেন,চাচা, আপনি চুপ করবেন? বললাম তো কিছু হবে না

পাশে বসা এক যুবক বলছিল, আমাদের পাইলটরা এক্সপার্ট ভেঙে পড়ার আগে পাশের ধানক্ষেতে সুন্দর মতো নামিয়ে দেবে একটু চোট লাগতে পারে তবে হাত পা ঠিক থাকবে

সবার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল, সব আত্মীয়রা মিলে একসাথে দেশে যাচ্ছে

আমার পাশের ভদ্রলোক একটি ল্যাপটপ আমাকে দেখিয়ে বললেন, দেখেন তো আপা কেমন? ভাইয়ের জন্য কিনেছি

 প্রথমে আমি অপ্রস্তুত বোধ করলাম পরে মনে হলো, আমরাও তো শাড়ি কিনে একে ওকে, পাশের বাসার ভাবীকে দেখাই তাদের মতামত জানতে চাই

আমি অবশ্য এসবের ভালো মন্দ তেমন বুঝি না বললাম, খুব সুন্দর তো!

তবে দাম শুনে অবাক হয়ে গেলাম এতো কেন?

এরই মধ্যে খাবার দেওয়া হলো বিমানবালা চেঁচাচ্ছে, এ্যাই আচার লাগবে কার?

বুঝলাম পুরাই আত্মীয় বাড়িতে এসেছি আমিও পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হলাম

শুনলাম আমার পাশে বসা ভদ্রলোক এখানে একটি চায়নিজ কোম্পানিতে সামান্য কাজ করেন মাসিক আয় শুনে মনে হলো, আহা বেচারা কতো মাসের সঞ্চয় দিয়ে এই ল্যাপটপ কিনলেন? ভাই কী করে জানতে চাইলাম বললেন, এসএসসি দিয়েছে

বললাম, এতো দাম দিয়ে কিনে দিতে হবে?

তিনি বললেন,শখ করছে ছোট ভাই কী করব?

আমার মনে হলো তার কষ্টের টাকায় তাদের গ্রামের বাড়ি এইসব রঙিন খেলনায় ভরে উঠছে রেগে গিয়ে বললাম,আপনার যেমন ওদের কথা মনে হলে ওদের জন্য প্রথমে মায়া হয় ওদের কিন্তু আপনার কথা মনে হলে প্রথমে গিফটের কথা মনে হয় 

তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন পরে বললেন, কথা ঠিক আছে

 

নায়ক নাকি খলনায়ক

ছোটবেলায় আমি শক্তিমান অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানকে পর্দায় খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখে খুব রেগে যেতাম বাবা, মা সিনেমা হলে ছবি দেখতে গেলে আমাকেও সাথে নিয়ে যেতেন অনেক আর্ট ফিল্ম দেখে যেমন ঘুমিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা আছে, তেমন আবার বাণিজ্যিক ছবির নায়িকার বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার, মারপিট গুলির শব্দে হলের ভেতর ঘুম থেকে জেগে ওঠার অভিজ্ঞতাও আছে

সিনেমার কোনো ভিলেইনকেই আমি সহ্য করতে পারতাম না, বিশেষ করে এটিএম শামসুজ্জামানের ব্যাপারে আমি আব্বাকে বলতাম, বাপি, বড় হয়ে আমি এই লোকটিকে মারব

সবাই হাসত তবে আব্বা আমাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন যে আসলে এই লোকটি ভালো কিন্তু সে শয়তানের অভিনয় করে- শয়তানরা যে কতো খারাপ তা সবাইকে বোঝানোর জন্য

আমি জানতাম না যে তিনি আব্বার ছোটবেলার বন্ধু পরে যখন আব্বা পুরনো ঢাকায় তার বাসায় নিয়ে গেলেন, আমি তো অবাক হয়ে গেলাম ভদ্রলোক, কী সুন্দর করে কথা বলেন! কতো মার্জিত, ড্রইংরুম ভর্তি বই

জানি না কেন বারবার তার মৃত্যুর খবর রটে আর তাকে প্রতিবাদ করতে হয় এবার শুনলাম তিনি লাইফ সাপোর্টে আছেন চাচার জন্য শুভ কামনা ভালো হয়ে উঠুন

আপনার শক্তিমান অভিনয় দেখেই আমি প্রথম অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা শিখি

 

 

বাবা মা সন্তান

আমার এক ছাত্রী আমার বাচ্চাদের পড়াতো হঠাৎ করে সে দেশে মানে তার হোম টাউনে চলে গেল বেশ অনেকদিন পর আসল চোখে পড়ল, তার হাতে কাটা ছেড়ার দাগ বললো, সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গিয়ে জেলি ফিশ লেগে এই হাল ভালো করে দেখে মনে হলো ছুরির দাগ জানতে চাইলে চুপ করে থাকে পরে নিজেই একদিন বলল,একজনের ওপর অভিমান করে সে এই কা- করেছে

স্টুডেন্টদের মধ্যে এই প্রবণতা সবখানে দেখা দেয় মাঝরাতে হয়তো বিষ খেল

হাসপাতালে ছোটাছুটি

 

আমার ছেলেরা বড় হচ্ছে হয়তো বেশ কয়েক বছর পরেই তাদের হৃদয় ঘটিত সমস্যার ঝামেলাগুলো আমাদের পোহাতে হবে এখন থেকেই আমি নার্ভাস

বোঝাই আত্মহত্যা মহাপাপ আরও বোঝাই আমি তাদের কতো ভালবাসি, তোমাদের যদি কিছু হয়, আম্মু কিন্তু মরে যাবে

একটি দশ বছরের ছেলে দুর্ঘটনায় মারা যাবার পর তার মা তাকে বলছিল, তোকে তো কখনো বলা হয়নি যে তোকে কতো ভালোবাসি

মৃত্যুর জন্য যেমন হাহাকার, না বলার জন্য যেন তার চেয়ে কম না

বাচ্চাদের বোঝাতে হয় আমাদের জীবনে তাদের গুরুত্বের কথা অনেক সময় মা বাবা ভাবেন আদর করলে তারা বেড়ে যাবে তখন শুধু শাসনের মধ্যে থেকে ধীরে ধীরে তাদের মনে হয়, সবাই তাকে বকে, কেউ তাকে চায় না  আত্মবিশ্বাস কমে যায়

খেলতে যাবার জন্য আমার বাচ্চাদের বিকেলে রাস্তা পার হতে হয়, যদিও এখানকার ড্রাইভাররা শিশু দেখলে গাড়ি থামিয়ে দেয় বা গতি কমিয়ে দেয় তবুও আমি বলি, যদি অ্যাকসিডেন্ট করিস, এমন মার খাবি, সারাজীবনের জন্য মনে থাকবে 

আমার বড় ছেলে বলে,  অ্যাকসিডেন্ট করার পর মারলে আমাদের তো অনেক ব্যথা লাগবে

অনেকেই মনে করে দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা রাজার হালে থাকে শুধু দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা গণরুমে থাকে, ডাল মেশানো পানি খায় তা না, বিদেশেও ছাত্ররা অনেক সময় সকালে নাস্তা করে না টাকা বাঁচানোর জন্য ক্লাস শেষে ব্রাঞ্চ করে

পাঠ্য বই কেনে না, ফটোকপি করে অনেকে পড়াশোনার চাপ সামলাতে না পেরে বাড়ি চলে যায়

বাবা মা তাদের ছোটবেলা থেকে ডানার ওমে রেখে মানুষ করে তাই পরে একাকি লড়াইয়ের শক্তি এদের থাকে না একদিকে একাডেমিক চাপ, অন্যদিকে মানি ম্যানেজমেন্ট; এরপরে যদি মড়ার ওপর খাড়ার ঘা- প্রেমে পড়ে তাল সামলাতে না পারে, তখন আত্মহত্যার মত সহজ পন্থা তারা বেছে নেয় যে নিজের কোনো দায়িত্ব নিতে শেখে নি, সে তার পরিপার্শে¦ মানুষের কষ্ট, তাদের ওপর তার দায়িত্বের কথা কীভাবে বুঝবে?

 

কিন্তু তোমাদেরকে বলছি যে মনে রেখ, তুমি যার জন্য বিষ খাবে সে এক সময় না এক সময় তোমার বিকল্প খুঁজে নেবে এটাই পৃথিবীর নিয়ম তবে তোমার বাবা মা কিন্তু তোমার বিকল্প কখনো পাবে না

ভালোবাসা বড় কিন্তু দায়িত্ববোধ তার চেয়ে বড় জীবন তার চেয়ে বড়

 

           

লেখক পরিচিতি:

নাহিদ আহসান

মালয়শিয়া প্রবাসী কবি, শিক্ষক, গবেষক

 


ক্যাটেগরিঃ কলাম,